সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন নগরকান্দা উপজেলার শহীদ নগর ইউনিয়নের চর ছাগলদি গ্রামের ব্যবসায়ী বাবু মোল্লা। নগরকান্দা বাজারে একটি হার্ডওয়্যার ব্যবসার দোকান ছিল তার। এ দোকানের আয় দিয়েই মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল তার। গত ২৮ মে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয় বাবু মোল্লা। এরপর থেকেই বাবু মোল্লার অবর্তমানে পরিবারটির উপর নেমে আসে কালো মেঘের আধার। ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে দুই শিশু সন্তানের পড়ালেখা। বাবু মোল্লার স্ত্রী তানিয়া আক্তারী, মা ফিরোজা বেগম, তিন সন্তান ফাতেমা (১১), জুনায়েদ (৬) ও ফারহানা (৩)’র প্রতিটি দিন কাটছে মানবেতরভাবে। খেয়ে না খেয়ে প্রতিটি দিন কাটছে তাদের। স্থানীয় গ্রামবাসীর সহযোগীতায় কোন রকমে চলছে দিন। আগামী ভবিষ্যত অন্ধকার দেখছেন নিহতের স্ত্রী তানিয়া আক্তারী। একদিকে স্বামী হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়া অন্যদিকে, স্বামীর হত্যাকারীদের প্রতিনিয়ত হুমকির কারণে একেবারেই দিশাহারা অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। বর্তমানে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে, হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেফতাদের দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয়রা।
মামলা সূত্রে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নগরকান্দা বাজারের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী ও বীরমুক্তিযোদ্ধা জিলু মোল্লার ছেলে বাবু মোল্লার কাছ থেকে ব্যবসার কথা বলে জনৈক জাকির মোল্লা দেড় লাখ টাকা ধার নেয়। সেই টাকা দীর্ঘদিন ধরে না দেবার কারণে বাবু মোল্লা একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলার কারনেই বাবু মোল্লাকে কুপিয়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৩২টি লোহার পেরেক ঢুকিয়ে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। গত ২৮ মে নগরকান্দা বাজার থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাত সাড়ে নয়টার দিকে পায়ে হেঁটে বাড়ীর পথে রওয়ানা দেন বাবু মোল্লা। পথিমধ্যে চর ছাগলদি এমো মিয়ার পরিত্যক্ত একটি ইটভাটার কাছে পৌছালে বাবু মোল্লাকে মাথায় আঘাত করে ফেলে দেওয়া হয়। পরে তাকে কুপিয়ে মারাত্বক ভাবে আহত করার পর শরীরের মাথা, হাত,পাসহ বিভিন্ন স্থানে লোহার পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতে হাত-পারে রগ কেটে ফেলা হয়। পরে বাবু মোল্লাকে রাস্তার একপাশ থেকে টেনে অন্যপাশের কুমার নদীতে পেট কেটে ফেলে দেবার সময় রাস্তা দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে যাওয়া দুই ব্যক্তি দেখে ফেললে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। পরে মুমুর্ষ অবস্থায় বাবু মোল্লাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাতেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেবার পর সেখান থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকায় নেবার পথে মারা যায় বাবু মোল্লা। মারা যাবার আগে বাবু মোল্লা তার উপর হামলার সাথে জড়িতদের নাম বলে জায় স্বজনদের কাছে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী তানিয়া আক্তারী বাদী হয়ে মোঃ আল আমিন মিয়া, মোঃ জাকির মোল্লা, আমির মোল্লা, শামীম মোল্লা, মোঃ হিরু মোল্লা, আফজাল মোল্লা, হায়দার মোল্লাসহ অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামি করে নগরকান্দা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলার পর পুলিশ ৭ নম্বর আসামী, ভ্যানচালক হায়দার মোল্লাকে আটক করলেও মূল আসামীদের কাউকেও আটক করতে পারেনি।
নিহত বাবু মোল্লার মা বয়োবৃদ্ধা ফিরোজা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে যারা নির্যাতন করে খুন করলো তারা এখনো ধরা পড়েনি। তারা মামলা তুলে নিদে হুমকি দিচ্ছে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, আমি আমার সন্তানের হত্যার বিচার চাই। বাবু মোল্লার স্ত্রী তানিয়া আক্তারী বলেন, আমার স্বামীকে যারা মেরেছে তারা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের ধরছেনা। আমাকে বিভিন্ন্ ভাবে হুমকি দিচ্ছে। তারা আমার ও আমার শিশু সন্তানদে ক্ষতি করতে চায়। আমি খুব ভয়ে আছি, তারা যে কোন সময় আমাদের ক্ষতি করতে পারে। বর্তমানে আমি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আমার বড় মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ও ছোট ছেলে ১ম শ্রেনীতে পড়ালেখা করে। ওদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরে খাবার নেই। আমি এখন কিভাবে বাঁচবো। আমি আমার স্বামীর খুনিদের ফাঁসি চাই। বাবু মোল্লার ভাই ফিরোজ মোল্লা বলেন, বাবুকে খুন করার পর থেকেই আসামিরা মামলা তুলে নিতে হুমকি দিচ্ছে। মামলা তুলে না নিলে আমাদের ক্ষতি করবে বলে জানিয়েছে। তারা নিজেরা নিজেদের বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেবার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। শহীদ নগরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, একজন বীরমুক্তিযোদ্ধার ছেলেকে যেভাবে নৃসংশভাবে হত্যা করেছে তা এ সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায়না। শরীরের বিভিন্ন স্থানে লোহার ডেরেক ঢুকিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়েছে। আসামিরা এলাকায় ঘোরাফেরা করছে কিন্তু পুলিশ তাদের ধরছেনা। স্থানীয় কয়েকজন জানান, বাবু মোল্লাকে যারা হত্যা করেছে তারা বেশ প্রভাবশালী। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে তারা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মামলার বাদীসহ সাক্ষীদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
এদিকে, বাবু মোল্লার হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয়রা।
নগরকান্দা-সালথা আঞ্চলিক সড়কের চর ছাগলদী এলাকায় এ কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান, বাবু মোল্লার স্ত্রী তানিয়া আক্তারী, ভাই ফিরোজ মোল্লা, নিহতের কন্যা ফাতেমা বেগমসহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে নগরকান্দা থানার ওসি মোঃ হাবিল হোসেন জানান, বাবু হত্যা মামলার একজন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার জবানবন্দিও আমরা নিয়েছি। বাকি আসামীদের গ্রেফতারে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। পলাতক থাকায় তাদের আটক করা যাচ্ছেনা।