দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের দুয়ার খুলবে আগামী ২৫ জুন। এরপরেই বরিশাল থেকে ঢাকায় যেতে আর কোন ফেরি থাকছেনা। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে পারবে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। তাই পদ্মা সেতুর উদ্বোধণকে ঘিরে উল্লাসিত এই অঞ্চলের মানুষ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধণ করবেন। তাই উদ্বোধনকে স্মরনীয় করে রাখতে বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার ডিজিটাল ইউনিয়নখ্যাত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশ্ববর্তী গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনকে সাজানো হয়েছে নববধূর সাজে।
বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারপ্রাপ্ত মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক সৈকত গুহ পিকলু বলেন, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে স্মরনীয় করে রাখতে দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের একমাত্র অভিভাবক মন্ত্রী আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র নির্দেশনায় ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদকে বর্ণিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। এছাড়াও ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্নস্থানে ব্যানার ফেস্টুন স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী জনসভায় পদ্মাপাড়ে ইউনিয়নবাসীর সরব উপস্থিতির জন্য সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্পে নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে সাগরকন্যা কুয়াকাটার দুরত্ব মাত্র ২৬৫ কিলোমিটার। যা ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চেয়ে প্রায় দেড়শ’ কিলোমিটার কম। সম্পূর্ণ ফেরিবিহীন ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটায় সড়কপথে ছয় ঘন্টায় পৌছানো সম্ভব হবে।
এছাড়া বাংলার বাঘ শের এ বাংলা একে ফজলুল হক ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাসের স্মৃতি বিজরিত বরিশালে পৌঁছানো সম্ভব হবে সাড়ে চার ঘন্টায়। তবে এজন্য ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেস ওয়েতে ভাঙ্গা পৌঁছানোর পরে একশ’ কিলোমিটার দক্ষিনে বরিশাল হয়ে ২১০ কিলোমিটার দুরে সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার কোন বিকল্প নেই। ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপদ বিভাগ থেকে মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য সড়কের পাশের অবৈধস্থাপনা উচ্ছেদে নোটিশ দেয়া হয়েছে।
ফেরি যুগের অবসান ॥ স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে দেশের সর্ব দখিণের বরিশাল বিভাগের সাগরকন্যা কুয়াকাটা থেকে রাজধানী ঢাকায় আসা-যাওয়ায় ফেরি পারাপারের সীমাহীন ভোগান্তির অবসান হতে যাচ্ছে। অতীতে ঢাকা থেকে সড়কপথে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত আসতে ১৪টি ফেরি ছিলো। দীর্ঘদিন থেকে বরিশাল বিভাগের মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়ে এসব ফেরি পারাপার হয়ে রাজধানীতে আসা-যাওয়া করতো। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে এই পথে সেই ফেরি যুগের অবসান ঘটতে চলেছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের মেগা প্রকল্পগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ অফিস সূত্রে জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে কুয়াকাটা থেকে ঢাকা পর্যন্ত মোট ১৪টি নদীর ওপর ফেরি ছিলো। একেরপর এক ফেরি পার হয়ে সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত পৌঁছতে ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ ঘন্টারও বেশি সময় লেগে যেতো। ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো যাত্রী সাধারণদের। বিশেষ করে এসব ফেরি ঘাটে চরম ভোগান্তিতে পরতে হতো এ্যাম্বুলেন্সবাহী রোগী ও তাদের স্বজনদের। সেই ভোগান্তির অবসান হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। এ খবরে ব্যাপকভাবে উল্লাসিত ভূক্তভোগী সেইসব দক্ষিণাঞ্চলবাসী। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতীতের চরম দুর্দশার স্মৃতি তুলে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার সংবাদকর্মী মেজবা উদ্দিন মাননু বলেন, এই রুটের ১৪টি ফেরি পাড়ি দিয়ে সড়ক পথে ঢাকায় পৌঁছতে হয়েছে। অনেক কষ্ট হতো ফেরি পারাপারে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্য উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ঘাটে সেতু নির্মান করা হয়েছে। তবে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো পদ্মা নদী পাড়ি দেয়া। এবার সেই চ্যালেঞ্চকে বাস্তবে রূপ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে অতীতের সীমাহীন ভোগান্তির অবসান করবেন।
বাউফলের সংবাদকর্মী কামরুজ্জামান বাচ্চু বলেন, পদ্মার বুকে নির্মিত এটি শুধু একটি সেতুই নয়; এটি বাংলাদেশের সক্ষমতার স্মারক। দেশ-বিদেশের কতিপয় ব্যক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এক স্বপ্ন জয়ের ইতিহাস। বিশ্ব দরবারে আজ আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারি, আমরাও পারি। বাকেরগঞ্জের সংবাদকর্মী জিয়াউল হক বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে অসাধ্যকে সাধন করায় বরিশালসহ গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিরঋণি হয়ে থাকলো। নলছিটির সংবাদকর্মী খালিদ হাসান তালুকদার বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের দক্ষিণাঞ্চলবাসীর আত্মবিশ্বাস আর নির্ভরতার প্রতীক। এই সেতুর সুফল সবচেয়ে বেশি ভোগ করবো আমরা দক্ষিণাঞ্চলবাসী। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এসব এলাকার অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এখানকার কৃষি, মৎস্য, পর্যটন ব্যবসা পদ্মা সেতুর কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২০ আগস্ট কলাপাড়া উপজেলার শিববাড়িয়া নদীর ওপর ‘শেখ রাসেল সেতু’ উদ্বোধণ করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি একই উপজেলার সোনাতলা নদীর ওপর ‘শেখ জামাল সেতু’ এবং আন্ধারমানিক নদীর ওপর ‘শেখ কামাল সেতু’ উদ্বোধণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পটুয়াখালীর লাউকাঠি নদীর ওপর ‘পটুয়াখালী সেতু’, ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর পায়রা (লেবুখালী) নদীর ওপর ‘পায়রা সেতু’, ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বরিশালের দপদপিয়া নদীর ওপর ‘শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু’, ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার সুগন্ধা নদীর ওপর ‘ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু’ ও একইবছর উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদীর ওপর ‘এমএ জলিল সেতু’, ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর ‘আড়িয়াল খান সেতু’, ঝালকাঠীতে ‘গাবখান সেতু’সহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে অসংখ্য নান্দনিক সেতু উদ্বোধণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশেষে আগামী ২৫ জুন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধণের মধ্যদিয়ে ঢাকা-কুয়াকাটা সড়ক পথে চিরচেনা ফেরি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে।
পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মেগা প্রকল্পগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখা সহজতর হবে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। মানুষজন বরিশাল থেকে সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে কাজ শেষে আবার সন্ধ্যায় বরিশালে পৌঁছতে পারবেন। বড় বড় শিল্পোদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য দক্ষিণাঞ্চলে আসতে শুরু করেছেন। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধণের পর অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। পায়রা সমুদ্রবন্দর, পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাহাজ তৈরির কারখানায় সুফল আসবে।
দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের একমাত্র অভিভাবকখ্যাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ত্রী আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর ভাগ্যন্নোয়নের জন্য কিছুই চাইতে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ততোবারই এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি দিয়েছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।