সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখন নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন, নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে পিছিয়ে নেই। তাদের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
আগরদাড়ি ইউনিয়নের ৫টি, বল্লী ইউনিয়নের ৩টি এবং ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নে ৫টি গ্রামে ঘুরে জানা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার দরিদ্র ও হতদরিদ্র। অধিকাংশ মানুষ অন্যের ক্ষেতে খামারে মজুরী খেটে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। কেউবা গ্রাম থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে ঝুড়ি-ডালা তৈরী করে বিক্রি করে সংসার চালায়। দলিত ও প্রান্তিক শ্রমজীবী এসব মানুষের পক্ষে নিরাপদ পানি কিনে পান করা অত্যন্ত কষ্টকর। তাই অর্থের অভাবে কিছু কিছু পরিবার সুপেয় পানি ক্রয় করে পান করতে পারে না। পাকা পায়খানা নির্মাণ করতে পারে না। দলিত শ্রেণির মানুষ একসময় খোলা আকাশের নিচে বনে-ঝোপের আড়ালে, রাস্তার ধারে বসে তারা মলত্যাগ করতো। কেউ কেউ আবার ৪ থেকে ৫টি রিংস্লাব বসিয়ে বস্তা কিংবা কাপড় দিয়ে ঘিরে সেখানেই মলত্যাগ করতো। এমনকি একটি পায়খানা ৩-৪টি পরিবার ব্যবহার করতো। মলত্যাগের পরে মানুষ মাটি বা ছাই দিয়ে হাত পরিস্কার করতো। দলিত এনজিও ওয়াশ এসডিজির প্রকল্প ২০১৮ সাল থেকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ী, বল্লি ও ঝাউডাঙ্গা এই ৩টি ইউনিয়নে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানার ব্যবহার, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সাবানের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করেছে।
সদর উপজেলার এই ১৩টি গ্রামের ১৩টি পাড়ার দলিত জনগোষ্ঠীর ৬৩১টি পরিবারের মধ্যে ৩০ শতাংশ পরিবারের এখনো গভীর নলকুপের অভাব থাকলেও তারা নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন ব্যবহার করছে। তাদের বেশিভাগ মানুষ নিরাপদ পানি দূর থেকে সংগ্রহ করে ও জারের পানি কিনে পান করে। আগরদাড়ি ইউনিয়নের বাবুলিয়া ঋষিপাড়া, ইন্দ্রিরা কায়পুত্রপাড়া, চুপড়িয়া ঋষিপাড়া, রামেরডাঙ্গা ভগবেনেপাড়া ও কাশেমপুর হাজামপাড়ার প্রায় ২৫২টি পরিবারের নারী-শিশু মিলে প্রায় ১১৬০ জন মানুষের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি, স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন, ঋতুকালীন সময়ে দলিতের নারীরা নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করে। আগরদাড়ী ইউনিয়নে সুপেয় পানির সমস্যা নেই। বল্লী ইউনিয়নের কাঁঠালতলা ঋষিপাড়া, মুকুন্দপুর কারিকরপাড়া ও রায়পুর ভগবেনেপাড়ার ১৭৫টি পরিবারের প্রায় ৮৭৫জন মানুষ নিরাপদ পানি পান করে। তবে গভীর নলকুপের অভাবে অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ পানি কিনে পান করে। কিছু পরিবার দলিতের সচেতনতার কারণে পানির ফিল্টার তৈরী করে সেখান থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করে পান করছে। স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরীও করছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবানের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য সংগ্রহকালে জানা যায়, মানুষ এখন সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে কোন খাবার খায় না। মলত্যাগের পর মানুষ এখন সাবানের ব্যবহার নিশ্চিত করেছে।
ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া ঋষিপাড়া, বলাডাঙ্গা কারিকরপাড়া, মাধবকাঠি কলোনীপাড়া, আখড়াখোলা কারিকরপাড়া ও ওয়ারিয়া কায়পুত্রপাড়ার ৩০৪টি পরিবারের ১৫২০ জনের মধ্যে ৮০শতাংশ মানুষ জারের নিরাপদ পানি ক্রয় করে পান করে। ৩টি ইউনিয়নের ১৩টি পাড়ার যেসব অগভীর নলকূপ আছে সেগুলোর অধিকাংশই আয়রন ও আর্সেনিকযুক্ত। দারিদ্র্যর কারণে আর্সেনিক ও আয়রনযুক্ত নলকূপের গোড়া এখনো অনেকের পাকা করা হয়নি। ঝাউডাংগা ইউনিয়নব্যাপী সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এ এলাকায় সুপেয় পানির লেয়ার পাওয়া যায় না। তাই দরিদ্র মানুষগুলো দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য এনজিওদের প্রতি ও সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে।
আগরদাড়ী ইউনিয়নের কাশেমপুর হাজামপাড়ার সেলিনা বেগম ও রফিকুল জানান, অত্র হাজামপাড়ায় নিরাপদ পানির খুবই সমস্যা। এই পাড়ায় কোন গভীর নলকুপ নেই। অন্য জায়গা থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে বা ফিল্টারের পানি ক্রয় করে পান করে থাকে। স্যানিটেশনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। আগের তুলনায় মানুষ এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কাশেমপুর হাজাম পাড়ার নারীরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ঋতুকালীন সময়ে নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করছে। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাসও গড়ে উঠেছে।
চুপড়িয়া ঋষিপাড়ায় প্রফুল্ল দাস জানান, এই এলাকায় একটি গভীর নলকুপ আছে। তারা সেখান থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পান করে। স্যানিটেশনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। পাড়ার নারীরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ঋতুকালীন সময়ে নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করছে। এমনকি তাদের সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছে।প্রফুল্য দাস বলেন অত্র এলাকার মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে। দলিত এনজিও আমাদের অনেক সচেতন করিয়েছে। ফলে আচরনগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এখন প্রায় মানুষ খাওয়ার আগে, পরে সাবান দিয়ে হাত ধুই। সুলেখা রানী বলেন ঋতুকালীন সময় নারীরা এখন নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করে।
বাবুলিয়া ঋষিপাড়ার রিনা দাস, রামপ্রসাদ দাস, দিপালী দাস, মঞ্জুরী দাস, কল্যানী দাস, সম্পা দাস জানান, এখানে দলিত ভিলেজ কমিটির সদস্য ৩০জন। এই এলাকায় একটি গভীর নলকুপ আছে, সেটা ক্যাম্পেশন প্রজেক্ট স্কুলের মধ্যে সেখানে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে অনেকেই ওখান থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পান করতো না। কিন্তু দলিত সংস্থার সচেতনমূলক কর্মকা- বাস্তবায়নের ফলে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ সচেতন হয়েছে। কিন্তু স্যানিটেশনের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রিনা রানী দাস বলেন, আমরা এখন সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভাত খাই এবং ঋতুকালীন সময়ে নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করে থাকি।
ইন্দ্রিরা কায়পুত্রপাড়ার সাধনা বিশ^াস, চন্দনা বিশ^াস জানান, এখানে দলিত ভিলেজ কমিটির সদস্য ৩০ জন। আমরা দলিত সংস্থার নিকট থেকে অনেককিছু শিখেছি, জেনেছি, সচেতন হয়েছি। ফলে চেয়ারম্যান মেম্বরের নিকট গভীর নলকুপের জন্য টাকা জমা দিয়েছি। এমনকি আমাদের পাড়ায় এখন দুটি গভীর নলকুপ স্থাপিত হয়েছে। আগে আমরা নিরাপদ পানি মোটের উপর পান করতাম না। বর্তমান শতভাগ নিরাপদ পানি পান করছি। কিন্তু স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে আমরা কেউকেউ সামর্থ অনুযায়ী পাকা পায়খানা তৈরী করেছি। কিন্তু পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ভাত খাই। মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস তৈরী হয়েছে। মাসিককালীন নারীরা সবাই নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করে। দলিত এনজিওর উদ্যোগে মানুষ এখন এসব বিষয়ে অনেক সচেতন হয়েছে।
একই কথা বলেন বল্লীর ইউনিয়নের মুকুন্দপুর জেসমিন ও রোকছানা। তারা বলেন, এখানে দলিত ভিলেজ কমিটির সদস্য ৩০ জন। এই এলাকায় মাটির সমস্যার কারণে গভীর নলকুপ স্থাপন হয় না। তবে কেউ কেউ দূর থেকে পানি সংগ্রহ করে নিরাপদ পানি পান করে আবার কেউ কেউ নিজেরা ফিল্টার তৈরী করে সেখান থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পানি পান করে। কিন্তু সরকার যদি পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতো তাহলে হয়ত: বল্লি ইউনিয়নের সমস্ত মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারতো। তাই তারা অত্র এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। কাঠালতলার সন্ধা রাণী দাস ও মনিমালা জানান, এখানে দলিত ভিলেজ ওয়াশ কমিটির সদস্য ৩০জন। এই এলাকায় কোন গভীর নলকুপ নেই। এখানকার পানি বেশিভাগ আয়রন ও আর্সোনিকযুক্ত হওয়ার কারণে তাদের নিরাপদ জারের পানি কিনে পান করতে হয়। সুপেয় পানির লেয়ার না থাকার কারণে এই এলাকায় গভীর নলকুপ স্থাপন হয় না। সরকার যদি পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করে তাহলে হয়ত: আমাদের ঋষিপাড়ার পানির সমস্যা দূর হতো। রায়পুর ভগবেনেপাড়ার আরোতী ও মমতাসহ অনেকে জানান, এখানে দলিত ভিলেজ কমিটির সদস্য ৩০জন। এই এলাকায় কোন গভীর নলকুপ নেই। এখানকার মানুষ ঋশিল্পীর দেওয়া একটি ফিল্টারের পানি সংগ্রহ করে পান করে। পানি অপ্রতুল হওয়ায় সেখান থেকে কেউ বাড়ির পানিও পান করে অথবা অনেকে জারের নিরাপদ পানি কিনে পান করে। আরতী রানী বলেন, সুপেয় পানির লেয়ার না পাওয়ার কারণে এই এলাকায় গভীর নলকুপ স্থাপন হয় না। তাই পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া ঋষিপাড়ার সুমন দাস, সাধন দাস, রাধারানী ও আরতী রানী জানান, এখানে কোন গভীর নলকুপ নেই। এখানকার মানুষ ঋশিল্পীর দেওয়া একটি ফিল্টারের পানি অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পান করে আবার অনেকে জারের পানি কিনে পান করে। তবে স্যানিটেশনের অবস্থা মোটামুটি ভালো। মাধবকাঠি কলোনীপাড়ার তহমিনা খাতুন, শাহানারা খাতুন ও সাবিনা বেগমও একই কথা বলেন। বলাডাঙ্গার কারিকরপাড়ার মাশকুরা, পারুল, রন্তা, জামিলা ও মোসলেমা জানান, এখানে কোন গভীর নলকুপ নেই। এখানকার মানুষ দূর থেকে নিরাপদ পানি এনে পান করে এবং অনেকে কেনা পানি পান করে। আখড়াখোলার নারগিস নাহার, রুপা, আঁখি জানান, এলাকায় কোন গভীর নলকুপ নেই। এখানকার মানুষ দূর থেকে নিরাপদ পানি সংগ্রহ করে পান করে এবং অনেককে নিরাপদ পানি কিনে পান করতে হয়। ঋতুকালীন সময়ে নারীরা নিরাপদ ন্যাপকিন ব্যবহার করে থাকে। তারা নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
আগরদাড়ী, বল্লী ও ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের এসব মানুষ আরো জানান, যেসব স্থানে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই সেই সব স্থানে জরুরী ভিত্তিতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিরাপদ পানি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের কায়পুত্রপাড়ার মানুষের যাতয়াতের জন্য কোন রাস্তা পর্যন্ত নেই। এই পাড়ার মানুষ সবচেয়ে হতদরিদ্র। তারা অনেক কষ্ট করে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ফিল্টারের পানি ক্রয় করে পান করছে। কিন্তু স্যানিটেশনের অবস্থা অনেকের নাজুক পর্যায়। এই শ্রেণির মানুষদের উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে, সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মো: মনিরুজ্জামান জানান, আমরা সাতক্ষীরা সদর উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ৯০ ভাগ নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সরেজমিনে দেখা যায়, বল্লি ও ঝাউডাংঙ্গা ইউনিয়নের সকল মানুষ নিরাপদ পানি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।