সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে হেলিকপ্টার থেকে দেওয়া ত্রাণ সংগ্রহ করতে বন্যাদুর্গত মানুষের ভিড় আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, সেখানে ত্রাণ আনতে গিয়ে আহত হয়েছে দেশের হতদরিদ্র-বন্যাপীড়িত মানুষেরা। সাথে যুক্ত হয়েছে- টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত অধিকাংশ ঘর-বাড়ি ও রাস্থাঘাটে এখনো পানির মত কষ্ট-যন্ত্রণা। এত কষ্ট যন্ত্রণার মধ্যে খুবই ধীরে ধীরে পানি নামতে থাকায় মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছানোয় গরিব-অসহায় মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তারা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কষ্টে তাদের দিন কাটছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে বানভাসিরা অর্ধাহারে-অনাহারে রয়েছেন। দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার। এ ছাড়া বানভাসিদের মধ্যে রোগবালাইও ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন স্থানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি সেভ দ্য রোড সুনামগঞ্জের সভাপতি আহমদ আল কবির চৌধুরী চরম কষ্টকে পাশ কাটিয়ে তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন নির্মমতার হাত থেকে উত্তরণের আকুতি ঠিক এভাবে-
‘আমরা সুনামগঞ্জবাসী ভালো নেই!
চোখের পানি বৃষ্টির পানির সাথে একাকার।
আমাদের অধিকাংশের ঘর নেই, ভেঙে গ্যাছে
খাট নেই, ভেসে গ্যাছে
চুলো নেই, ডুবে গ্যাছে
ধান ভেজা, কাঁথা ভেজা, ভেজা সব সুখ
সবারই একবস্থা কে দেখে কার দুখ?
মাননীয় জেলাপ্রশাসক! দ্রুত একটা ব্যাবস্থা করুন এবং আজ রাতের মধ্যেই। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্ধি। যোগাযোগহীন অসহায়। পানির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কারো খুঁজ নিতে পারছেন না। আমার চেনাজানা অনেকে সড়কে আছে। বর্জ্য ব্যাবস্থাপনা ডেঞ্জারাস পর্যায়ে।
আমি '৮৮'র বন্যা দেখেছি। এবারের বন্যার মতো ভয়াবহতা দেখিনি। আপনি না পারলে প্রাইম মিনিস্টারকে বলুন। সেনাবাহিনী মোতায়েন করুন। মানুষকে উদ্ধার করুন। শুকনো খাবার, সুপেয় পানি, টর্চ লাইট ও মোমবাতি দ্রুত সরবরাহ করুন।
আশ্চর্য হই জাতীয় কোনো সংবাদ মাধ্যমই এ আকস্মিক বন্যার ভয়াবহতা নিয়ে এখনও উল্লেখযোগ্য কোনো নিউজ করছে না! কেন? মানুষের কোনো দাম নেই বুঝি?
স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী, চেয়ারম্যান ও মেম্বার, আপনারা কোথায়? আপনাদের দায়িত্ব কী? দুয়েকটা দিন অন্তত পানিবন্ধি মানুষের কাছে আসা যায় না? নৌকা না থাকলে ভাড়া পাওয়া যায় না? সরকারীভাবে প্রতি ইউনিয়নে অন্তত তিনটি বড় নৌকা ক্রয় করা যায় না?
প্লিজ, মানুষ মরার আগে দেখুন! মরার পরে সমবেদনা জানানোর দরকার নেই।’
বিশ^ময় জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি পাশর্^বর্তি বন্ধুদেশের সাথে পানি বন্টনে নীতিগত সিদ্ধান্তে না আসতে পারায় স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এসে বন্যাক্রান্ত দেশের প্রধান সব নদনদীর পানি বাড়ছে। এ কারণে কিশোরগঞ্জ, রংপুর, নীলফামারী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এই আশঙ্কার মধ্যেই গত ২৪ জুন নির্মম বন্যার পানিতে জল-স্থল সমাবেশ করেছেন নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির রাজনীতিক। তাদের দাবি ছিলো বন্যা থেকে বাঁচতে সঠিকভাবে পানিবন্টন চুক্তি বাস্তবায়ন করা হোক। নতুন করে প্লাবিত হতে পারে শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার নিম্নাঞ্চল। দেশের আটটি নদীর ১৮ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ২৩ গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ভাঙনকবলিত মানুষ। আমরা নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির পক্ষ থেকে সরাসরি বন্যাক্রান্ত মানুষদেরকে ভালোবাসা-সহায়তা দিতে গিয়ে দেখেছি০ সুরমা নদীর পানি ধীরগতিতে নামলেও কুশিয়ারা নদীর পানি বাড়ছে। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ছে। সুবিধাজনক স্থানে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছলেও যাতায়াতের অসুবিধার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রসহ অনেক স্থানে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছছে না। সব জায়গায় ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনও পরিবহণ ভাড়া বেশি হওয়ায় দুর্গম এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছে না। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যার কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বন্যাক্রান্ত ১৩ জেলা উৎসব বাতিল করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা যদি দেয়া হতো, তাহলে আর কষ্টময় হতাশার দীর্ঘশ^াসে ভাসতো না বাংলাদেশ। বিশেষ করে যেই ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভার পুরোপুরি এবং সিটি করপোরেশনের ৮০ ভাগ এলাকা বন্যাকবলিত-পানিবন্দি প্রায় ৩০ লাখ মানুষ প্রতিদিন-প্রতিরাতে হাহাকার করছে। এরমধ্য থেকে কেবলমাত্র আড়াই লাখ মানুষ পাঁচ শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে; যা সত্যিকার্থেই কষ্টকথা। এই কষ্টসময়ে আমরা দেখেছি- রাষ্ট্রিয়ভাবে ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে বন্টন করা হয়েছে- ৬১২ মেট্রিক টন চাল, ৭ হাজার ৯০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে; ৮ হাজার ১১৮ প্যাকেট শুকনো খাবার আছে। সুনামগঞ্জে ৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১৪০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। চারটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াটার প্ল্যান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া আড়াই লাখ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগেও ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
অন্ধকারের রাজনীতির কারণে নীতি থেকে সরে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক কর্মীরা লোক দেখানোর জন্য ত্রাণ দিয়ে আবার সেই ত্রাণের বস্তা কেড়ে নেয়; এমন নির্মমতার হাত থেকে মুক্তি চায় আমজনতা। তাদের সেই মুক্তির কথা ভেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও অন্য ইউনিটের সহায়তায় বন্যাকবলিত অর্ধ লাখ মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ হাজার গবাদি পশু উদ্ধার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ড ইউনিটসহ ১৩টি ব্যাটালিয়নের ২৩ প্লাটুন সদস্য সিলেট ও সুনামগঞ্জে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকলেও এগিয়ে আসেনি সরকারের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা। তাদের পদ্মা সেতুর উদ্বোধনে ব্যয়কৃত ২০০ শত কোটি টাকা কষ্টসময়ে সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বন্যাক্রান্ত ১৩ জেলার মানুষের কাছে পৌছে দিলে দেশ হাসতো, হাসতো দেশের মানুষ। সেই হাসি নেই বলেই আজ জাতির ক্রান্তিকালে লোভ মোহহীন নতুনধারার রাজনীতিকেরা রাজপথে-কাজপথে প্রতিনিয়ত থাকছে। সচেনতা তৈরি করে বন্যাক্রান্তদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে- বন্যাকবলিত এলাকায় বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে কিছুটা সর্দি-কাশি, ঠান্ডাজনিত রোগ দেখা দিয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘর-বাড়িতে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
বালাগঞ্জ উপজেলার শতভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা বানভাসি মানুষের মধ্যে চরম মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি লোকজন খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িসহ বিভিন্ন উঁচু বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন। সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না বলে তারা অভিযোগ করেন। উপজেলার কয়েক হাজার পুকুর ও মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। গবাদি পশুর খাদ্য সংকটে বিপাকে পড়েছেন মানুষ। ছাতক উপজেলায় বন্যার পানিতে শত শত ঘর-বাড়ি, ক্ষেতের ফসল ও পুকুর তলিয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন ও পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। এদিকে হাট-বাজার ও রাস্থাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সব পণ্যের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ-প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে বলে আমি মনে করি।
যখন বন্যাক্রান্তদের চারপাশে কষ্ট, তখন মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে চোর-ডাকাতদের উপদ্রবও বেড়ে গেছে, নেত্রকোনা : জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও খালিয়াজুরী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা ও খালিয়াজুরী উপজেলাসহ ১০টি উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। বেশি খারাপ অবস্থা কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও খালিয়াজুরী উপজেলা। বন্যায় গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় এবং বিভিন্ন স্থানে ভেঙে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ১২ লক্ষাধিক মানুষ। বানভাসি মানুষের অভিযোগ, তারা প্রয়োজনীয় ত্রাণ পাচ্ছেন না। বন্যায় মদন উপজেলার ৮ ইউনিয়নের ৪ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ভেসে গেছে ছাত্র-যুব-জনতার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে নতুন করে আলোর ঘরে রিটার্ন আনতে তৈরি হতে হবে বাংলাদেশের সর্বোস্তরের মানুষকে। যদি দুর্নীতি হয়; হবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বন্যাক্রান্তদের সহায়তা-ত্রাণ সঠিকভাবে বন্টনের লক্ষ্যে। যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা না বলেন, যদি দুর্নীতিকে প্রতিরোধ না করেন, নিরব কষ্ট এসে গ্রাস করবে বাংলাদেশকে; যা আমাদের কারোই প্রত্যাশা নয়; তাই চাই অপচয়রোধ-দুর্নীতিরোধ করে গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকুক বাংলাদেশ সরকারের সকল মন্ত্রী-এমপি-জনপ্রতিনিধি...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি