রাজবাড়ীর সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের তিন ভাই ইউসুফ মন্ডল, ছলিম উদ্দিন মন্ডল ও আজিম উদ্দিন মন্ডল। একসময় কৃষি কাজ করলেও তিন ভাই এখন বাড়ীতে নাতি নাতনীদের সাথে সময় কাটান। কিছু দিন আগে তাদের বাড়িতে তিন ভাইয়ের নামে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা শেকে থেকে লাল নোটিশ আসে। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেনি। যা সুদে আসলে এখন হয়েছে একলক্ষ ১৫ হাজার টাকা। নোটিশে লেখা গ্রেফতারী পরোয়ানা/ মালামাল ক্রোকের পূর্ব সতর্কীকরণ জরুরী নোটিশ। কিন্তু তিন ভায়ের অভিযোগ তারা কখনো কৃষি ব্যাংকেই যাননি। ঋণের জন্য কৃষি ব্যাংকে কখনো আবেদনই করেননি। তারপরও এমন নোটিশ ব্যাংক কেন দিবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই তিন ভায়ের নাম, ঠিকানা ব্যবহার করে ২০১৫ সালে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখা হতে ৬০ হাজার টাকা করে ঋণ নেয় একটি চক্র। তবে ব্যাংক নাম ঠিকানা তিন ভায়ের ব্যবহার করলেও ছবি অন্য মানুষের। আবার ব্যাংক জমা দেয়া জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপিতে দেখা যায় নাম, ঠিকানা ঠিক থাকলেও তাদের আসল জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর আর জন্ম তারিখের মিল নেই।
রাজবাড়ীর সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বারেক শেখ, লতিফ শেখ, আবদুস ছাত্তার, মজিবর রহমান, রহিম ধাবকসহ এমন অনেক কৃষকই কৃষি ব্যাংকের এমন নোটিশ পেয়েছেন। সম্প্রতি ব্যাংক থেকে ওই সকল কৃষকের নামে খেলাপী ঋণের লাল নোটিশ গেলে বিষয়টি জানাজানি হয়। কৃষি ব্যাংকের এই ঋণ জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের কর্মকর্তারই জরিত বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ আর মিজানপুর ইউনিয়নের শতাধিক কৃষকের নামে এমন নোটিশ গিয়েছে। যারা আসলে ব্যাংক থেকে কখনো ঋণ নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে কৃষি প্রধান কার্যালয় থেকে তদন্ত চলছে।
ব্যাংকের দেয়া নোটিশের সুত্র ধরে জানা যায়, কৃষি ব্যাংকের ঋণের কাগজপত্রে জমা দেয়া জাতীয় পরিচয় পত্রে দেখা যায়, ঋণ গ্রহিতার নাম ইউসুফ মন্ডল, পিতার নাম মৃত হারান মন্ডল আর মায়ের নাম নুরজাহান বেগম। আর জন্ম তারিখ লেখা ১ জানুয়ারী ১৯৭৬। গ্রাম গোবিন্দপুর, ডাকঘর খানগঞ্জ লেখা। জমা দেয়া জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপিতে ছবি অস্পষ্ট। তবে ফাইলের সাথে দুই কপি ছবি অন্য মানুষের। ইউসুফ মন্ডলের গোবিন্দপুরের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এই বৃদ্ধের সাথে। তার জাতীয় পরিচয় পত্রে দেখা যায়, জন্ম তারিখ ২৭ অক্টোবর ১৯৫১।
ইউসুফ মন্ডল বলেন আমরা কখনো কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ করিনি। আজ থেকে ২০ বছর আগে একবার ব্যাংকে ঋনের জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু নানা কাগজপত্র আর শর্ত পূরণ করতে না পারায় আমরা ঋণ নিতে পারিনি। সেই ব্যাংক কিভাবে আমার নামের ঋণ অন্য মানুষের দেয়। এখানে ব্যাংকের লোকজন জড়িত। আর ব্যাংকে জমা দেয়া জাতীয় পরিচয় পত্রে আমার যে জন্মতারিখ দেয়া তার থেকে আমার ছেলের বয়সই বেশি।
কৃষি ব্যাংকে জমা দেয়া ইউসুফ মন্ডল নামের জাতীয় পরিচয় ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, ইউসুফ মন্ডল নামের জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বার দিয়ে নির্বাচন কমিশন অফিসে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়। নির্বাচন অফিসের দেয়া তথ্যে দেখা যায় মোঃ খবির উদ্দিন শেখ, পিতা খোরশেদ আলী শেখ, গ্রামঃ গোবিন্দপুর, ডাকঘরঃ খানগঞ্জ, রাজবাড়ী। আর জন্মতারিখ ১ জানুয়ারী ১৯৭৬। নির্বাচন কমিশনের দেয়া জাতীয় পরিচিতি তথ্যে যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেই ছবি আর কৃষি ব্যাংকের ঋনের ফাইলের ছবি একই ব্যক্তির। খবির উদ্দিনের সাথে কথা বলার জন্য এই প্রতিবেদক যায় গোবিন্দপুর গ্রামে। বাড়িতে গেলে খবির উদ্দিন সাংবাদিক পরিচয় শুনেই বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় বাড়িতে থাকা খবির উদ্দিনের স্ত্রীও কোন কথা না বলে ঘরের মধ্যে চলে যায়।
একই গ্রামের বারেক শেখ ও তার ছেলে লতিফ শেখ নামে কৃষি ব্যাংকের ঋণ খেলাপীর জন্য লাল নোটিশ পেয়েছে। বারেক শেখ বলেন, আমার ছেলে কৃষি কাজ করে। বয়স হয়ে যাবার কারণে আমি কোন কাজ করতে পারি না। আমরা কোন ঋণ নেয়নি ব্যাংক থেকে। আর রাজবাড়ী কোথায় কৃষি ব্যাংক সেটিও আমি জানি না। কখনো ব্যাংকে যায়নি। এখন নোটিশ এসেছে আমি আমার ছেলের কাছে ব্যাংক এক লক্ষ ১৫ হাজার টাকা পায়। এই নোটিশ পেয়ে আবার দম বন্ধ হবার অবস্থা। আমরা একটা মগের মুল্লুকে বাস করি। যার যা খুশি করে যাচ্ছে।
একই ভাবে অনুসন্ধান চালানো হয় বারেক শেখের পাঠানো নোটিশ নিয়ে। অনুসন্ধানে বের হয় বারেক শেখের নামে কাগজপত্র তৈরি করে ঋণ নিয়েছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মোঃ শাহিন খান। তার পিতার নাম মোঃ মনছের আলী। রাজবাড়ী সদর উপজেলার বেলগাছী রেলস্টেশনের পাশে শাহিন খানের একটি ওয়ার্কশপের দোকান আছে। বিষয়টি নিয়ে শাহিন খানের সাথে কথা বলতে গেলে তিনিও দোকান ছেড়ে পালিয়ে যায়।
তবে আলিম মন্ডল নামে একজনকে খুজে পায় এই প্রতিবেদক। তার বাড়িও সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নে। আলিম মন্ডল জানান, ২০১৫ সালে কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার তৎকালিন কর্মকর্তা রেজাউল হকের সাথে পরিচয় হয়। তাকে বলি যে আমরা গরিব মানুষ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করি। সেখানে সুদ বেশি। আপনি আমার কৃষি ব্যাংক থেকে একটা ঋণ করে দেন। তারপর রেজাউল হক সব কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। আমার বাড়ি ছাড়া কোন জমি নেই। জমির কাগজও সেই তৈরি করে। ‘ আমার নামে ৭০ হাজার টাকা ঋণ হয়। কিন্তু ৩০ হাজার টাকা রেজাউল হক নিয়ে আামাকে ৪০ হাজার দেয়। এরপর কিছুদিন রেজাউল হক আমার কাছে ফোনে ঋনের টাকা চায়। আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছি ঋণ ব্যাংক থেকে নিয়েছি ব্যাংকে টাকা দেব। আপনার কাছে দেব না। আমি ব্যাংকের কোন নোটিশও পায়নি টাকাও দেয়নি। আমাদের এলাকায় কৃষি ব্যাংকে থেকে এমন ঋণ রেজাউল হকই করে দিয়েছে টাকার বিনিময়ে।
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয় অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা রেজাউল হকের সাথে। রেজাউল হক বর্তমানে কৃষি ব্যাংক শরীয়তপুর আঞ্চলিক অফিসে কর্মরত। তিনি জানান, তার সময়ে সব ঋণই সঠিক ভাবে বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ বিতরনে কোন অনিয়ম হয়নি। তিনি আরো জানান, অনেক কৃষক ঋণ নিয়ে নানা কারণে পরিশোধ করতে চায়না। আর আমার বিরুদ্ধে ভুয়া ঋণ পাশ করে দিয়ে টাকা নেবার অভিযোগ সঠিক নয়।
কৃষি ব্যাংক রাজবাড়ী শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক মোতাহার হোসেন বলেন, এই ঋণগুলো ২০১৫ সালে বিতরণ করা। আর আমি এসেছি অল্প কিছুদিন। এসব ঋণ নিয়ে ঢাকা অফিস থেকে তদন্ত চলছে। ঋণের সমস্ত কাগজপত্র তদন্ত কমিটি এক সাথে করে সিলগালা করে রেখেছে। তাই আমি এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।