আজ ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘ সংরক্ষনে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দীর্ঘ বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বাঘ দিবস। কিন্তু গত বছর করোনা ভাইরাস (কোভিট -১৯) এর বৈশ্বিক মহামারীর কারণে স্থানীয় ভাবে কোন কর্মসূচি পালিত হয়নি। তবে আজ সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জে “বাঘ আমাদের অহংকার, রক্ষা করার দায়িত্ব সবার।” এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আজ দিবসটি পালিত হয়েছে।
জাতীয় প্রাণী ও বীরত্বের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন। বাঘ বনের জীববৈচিত্র, খাদ্য শৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক। ২০১৮ সালে সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪ টি। তার পর প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ৪ টি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাচারকালে ১ টি বাঘের চামড়া সহ এক পাচারকারীকে আটক করে ব্যাব- ৮ ও বনবিভাগ। ঐ হিসাব থেকে কমে গেল ৫ টি বাঘ। এ মুহুর্তে সুন্দরবন কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক হিসাব নেই বনবিভাগের কাছে। কারণ গত চার বছর পার হলেও স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার বাঘ শুমারী হয়নি। তবে বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেছে সুন্দরবনে বাঘের আনা গোনা বাড়ছে। একাধিক বাঘ একত্রে পর্যটকদের চোখে পড়েছে। সে কারণে বনে বাঘ বেড়েছে বলে কেউ কেউ দাবি করছে। সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রনালয়ের দাবী বিভিন্ন মহলের।
বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরীর ভাষ্যমতে, ২০১০ সালে এই দিনে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বের বন্য অধ্যুষিত ১৩ টি দেশের প্রতিনিধিরা বাঘ রক্ষায় সম্মতি স্বাক্ষর করেন। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিল ( ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ)। অর্থায়নে ছিল বিশ্ব ব্যংক। উদ্দেশ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। শ্লোগান ছিল বাঘের বেঁচে থাকা আমাদের হাতে।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জর বিভিন্ন এলাকার চর থেকে মাত্র প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ৪ টি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। ময়না তদন্তে বাঘগুলোর বার্ধক্য জনিত কারণে মারা গেছে বলে বনবিভাগ জানিয়েছে। তবে ৪টি বাঘের একই রকম মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট বনের ছাপরাখালি এলাকা থেকে একটি, ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কবর খালি এলাকা থেকে একটি, ২০২১ সালের ১৯ মার্চ ধনচেবাড়িয়ার চর থেকে একটি ও চলতি বছর ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি একটি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। সেক্ষেত্রে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে এ প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. মোঃ শাহাদাত হোসেন এর ভাষ্যমতে ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের ১১৪ টি বাঘের মধ্যে যদি ২০টি প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী বাঘও থাকে তাদের থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০টি বাঘ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেখানে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে বাঘের জিনগত বৈচিত্রের অভাব। অল্প বাঘ থাকায় তাদের মধ্যে ইনব্রিডিং তথা নিকট সম্পর্কের মধ্যে প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে বাঘ শাবকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। তাই বাঘ সংরক্ষণে মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য বাঘের জিনগত বৈচিত্রও আনা প্রায়োজন। হেটারোজেনোসিটি বৃদ্ধি করতে পারলে বাঘের বংশ যেমন বৃদ্ধি পাবে সেই সঙ্গে বাঘের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও যে কোন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে বাঘকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। তার ভাষ্যমতে ভারতে ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাঘের সংখ্যা ৯৬ টি। কিন্তু এ সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৮৭ টি। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে বাঘ বেড়েছে ৯ টি। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় সুন্দরবন অংশে বাঘ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেখানকার বনবিভাগ অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ফলে ভারতে বাঘের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলে যে হারে জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হয়েছে তাতে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। এত অল্প সংখ্যক বাঘের প্রবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে টিকে থাকা ভবিষ্যতে খুবই কষ্ট সাধ্য হবে। তাই অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার বিষয় নানামূখী পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
খুলনা সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ডঃ মোঃ আনোয়ারুল কাদির এ প্রতিনিধিকে বলেন, বাঘ বিচরণের জন্য পরিবেশ বান্ধব ক্ষেত্র দরকার। বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র প্রজননের জায়গাটা অনুকুলে নিশ্চিত করতে হবে। পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন রক্ষায় প্রশাসনসহ সর্ব মহলের সহযোগীতা দরকার। বাঘ বেড়েছে কিনা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণের সময় বাঘ সাবক দেখেছে বলে জানা গেছে। সেটা সত্য হলে বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে। আগামী শীত মৌসুমে বাঘ শুমারী হবে। তখন সঠিক সংখ্যা জানা যাবে। ২০০১ সাল থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস পালিত হয়ে আসছে। সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রনালয় প্রয়োজন। তা না হলে সুন্দরবন সুরক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে।
সুন্দরবনের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (ওয়াইল্ড লাইফ) ডিএফও নির্মল কুমার পাল মানবকন্ঠকে বলেন, বাঘ আমাদের অহাংকার রক্ষা করার দায়িত্ব সবার এ প্রতিপাদ্যকে সমনে রেখে সুন্দরবনের ৪টি রেঞ্জে পালিত হবে সুন্দরবন দিবস। এ মুহুর্তে সুন্দরবনে কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক হিসাব বলতে পরবো না। তবে পর্যটক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেষার যে সব মানুষ বনে গেছে তারা বাঘ দেখেছে। তাতে মনে হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে। বাঘের সঠিক হিসাব পাওয়ার জন্য আগামী শীত মৌসুমে নভেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে বাঘ শুমারীর কাজ শুরু হবে। বন্য প্রাণী সুরক্ষায় পূর্ব সুন্দরবনের ধানসাগর এলাকায় ভোলা নদী ভরাট হওয়ায় ৬০ কলিমিটার লাইলনের বেড়া দেয়া হবে। বনের মধ্যে মিষ্টি পানি ধরে রাখার জন্য পুকুর খনন করা হবে। সুন্দরবনের বাঘসহ বন্য প্রাণীর আবাসস্থল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৬ লাখ ১ হাজার ৭ শত হেক্টর বনের মধ্যে বর্তমানে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর অভয়ারণ্য বন রয়েছে। যা ১৯৯৬ সালে মোট বনের ২৩% এবং পরে সম্প্রসার করায় বর্তমানে ৫৩% অভয়ারন্য এলাকা রয়েছে। যার আয়তন ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর।