হবিগঞ্জের মাধবপুরের ৫টি চা বাগানে বৈরী আবহাওয়ায় ও লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ঘাটতি’র সঙ্গে উৎপাদনের ভরা মৌসুমে যোগ হয়েছে চা শ্রমিকদের আন্দোলন। চা উৎপাদনের ভরা মওসুমে এমন আন্দোলনে অচলাবস্থা তৈরী হয়েছে চা বাগানে। এমনিতেই জুলাই উপজেলার লস্করপুর ভ্যালীতে সোয়া লাখ কেজি চা উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে। জুলাই আগস্ট মাসেই প্রায় ৪০ শতাংশ চা উৎপাদিত হয়। এ সময়ে লোডশেডিংএর পাশাপাশি আন্দোলনের ফলে চা-শিল্প চরম বিপর্যয়ের মূখে পড়েছে।
সারা দেশে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকা করার দাবি জানিয়ে অনির্দিষ্টকালের আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন। গত ৯ আগস্ট থেকে ১১ আগস্ট প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে সব বাগানে কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি বিক্ষোভ সমাবেশ করে। শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন শুরু করে শ্রমিকরা। রোববার সরকারি ছুটি এবং সোমবার শোক দিবসের কারণে ছুটি থাকায় বাগানগুলোতে কাজ হচ্ছে না। মঙ্গলবার থেকে শ্রমিকরা আবার আন্দোলনে নামছে। প্রতিটি বাগানের কারখানায় পচে নষ্ট হচ্ছে কাঁচা চা পাতা। পাশাপাশি ভরা মওসুমের চা গাছে নষ্ট হচ্ছে পাতা। এসব পাতা উত্তোলিত না হলে গাছেই নষ্ট হবে। এতে বাগানগুলো উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিবে।
এর আগে ১১ আগস্ট শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাহিদুল ইসলামের সঙ্গে ১০ চা শ্রমিক নেতার বৈঠক হলেও তা সুফল বয়ে আনেনি। এ সময় শ্রম অধিদপ্তর ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় চাইলেও শ্রমিক নেতারা তা না মেনে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেন।
শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত শ্রম অধিদপ্তরের উপপরিচালক নাহিদুল ইসলাম জানান, কর্তৃপক্ষ হিসেবে মহাপরিচালক চা শ্রমিকদের চিঠি দিলেও তারা এই চিঠির সম্মান না করেই আন্দোলনে নেমেছেন। এ ব্যাপারে মালিক পক্ষ কী কৌশল গ্রহণ করে তা আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, ‘শ্রম অধিদপ্তর আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করেছে। তারা আগামী ২৯ আগস্ট ত্রিপক্ষীয় আলোচনার সময় চেয়েছে। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। আমরা তিন দিন ২ ঘন্টা করে কর্মবিরতি করে বাগান কর্তৃপক্ষকে দাবি পুরণের সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু তারা কর্ণপাত করেনি। তিনি আরো বলেন, চা শ্রমিকরা তাদের ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, মজুরিসহ বিভিন্ন দাবিতে এই আন্দোলন করে আসছে। এই দাবি যৌক্তিক হওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষও তাদেরকে সমর্থন দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
চা সংসদের আহ্বায়ক তাহসিন আহমেদ বলেন, ‘চা শ্রমিকদের অযৌক্তিক আন্দোলনে চা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চা শ্রমিকদের সঙ্গে বাগান কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের ঝামেলা নেই। অথচ তারা অযৌক্তিকভাবে আন্দোলন করছেন। ’ তিনি জানান, তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা চলমান থাকাকালীন তারা হঠাৎ করে এ কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে, সেটা অবৈধ কর্মবিরতি, যা শ্রম আইনের পরিপন্থী।
এদিকে চা-শিল্পে উৎপাদন ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে শ্রমিকদের আইনবহির্ভূত কর্মবিরতি অবিলম্বে প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান শ্রম মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) খালেদ মামুন চৌধুরী এনডিসি। দ্রুততম সময়ে চলমান বিরোধ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ও চা-শিল্পে স্বাভাবিক উৎপাদনের পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি।
বাগানগুলোতে অতিবৃষ্টির পর এবার প্রচ- গরমের প্রভাবে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণে অধিকাংশ বাগানের বেহাল দশা। তা ছাড়া চলমান দৈনিক ১০/১২ ঘন্টার লোডশেডিংয়ের কারণেও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। উৎপাদন খরচ আর বিক্রয়মূল্যে অনেক চা বাগান এখন লোকসানে রয়েছে। এমন সময়ে শ্রমিকদের ধর্মঘট চা বাগানশিল্পের জন্য অশনিসংকেত। চলতি মওসুমের জুলাই পর্যন্ত ভ্যালীর ২৪ চা বাগানে ১ লাখ ২৫ হাজার কেজি চা উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। লোডশেডিং আর কর্মবিরতির কারণে চলতি মাসে বিপুল ঘাটতি থাকবে। ফলে এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা দেখছেন না বাগান সংশ্লিষ্টরা।
চা বাগান সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর, চুনারুঘাট, জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলের প্রায় ১৫ হাজার ৭০৩.২৪ হেক্টর জমিতে ২৫টি ফ্যাক্টরিযুক্ত চা বাগান রয়েছে। এ ছাড়া ফাঁড়িসহ প্রায় ৩৫টি বাগানের প্রায় প্রতি হেক্টর জমিতে ২২-২৫ শ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়। এসব বাগানে বছরে ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়ে থাকে।