রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপের। উচ্চ খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত এ ব্যাংকগুলো। উল্লেখ্য, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোতেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ (২০২১-২২) খেলাপি ঋণের যে অঙ্ক প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২২ শতাংশ। এই বিশাল খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে খেলাপি ঋণকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) করছে এফআইডি। কিন্তু বছর শেষে মূল্যায়নে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক স্থিতি রাখার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে তো পারছেই না এফআইডি; বরং প্রকৃত অর্থে ব্যাংকগুলোয় বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। দেশের সার্বিক আর্থিক খাতের জন্য এটি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। তাই যে কোনো উপায়ে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। বস্তুত এ পরিস্থিতির দায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরই বর্তায়। বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকের অভিভাবক। ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকির দায়িত্ব তার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে খেলাপি ঋণ না কমে বরং বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে কঠোর জবাবদিহির আওতায়ও আনা হচ্ছে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও এফআইডিকে খুব বেশি জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। তাই এ ধরনের চুক্তি (এপিএ) শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দিয়ে আসছে। বড় বড় খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের অগ্রগতি খুবই কম। এ পরিস্থিতি হতাশাজনক। খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজন সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় অবস্থান। আমাদের মনে আছে, দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা, এ টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে; সরকারি বা বেসরকারি যে ব্যাংক থেকেই ঋণ নেওয়া হোক না কেন, ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের এ ধরনের দৃঢ় অবস্থানের বাস্তবায়ন ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায় কঠিন বলেই মনে করি আমরা। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ঝুঁকি তৈরি করছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির প্রভাব পড়ছে ঋণ ব্যবস্থাপনায়। এ কারণে এগোতে পারছেন না ভালো উদ্যোক্তারা। ফলে বাড়ছে না বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। কাজেই খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। সমাধানটি এমন হওয়া উচিত যাতে ঋণখেলাপিরা যত প্রভাবশালীই হোন, তাদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা দিতে হবে। দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম দুষ্ট ক্ষত খেলাপি ঋণ সংস্কৃতির অবসান ঘটবে, এটাই কাম্য।