অবশেষে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করে চা বাগানের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির বাজারে এ মজুরি নেহায়েতই কম। এ দিয়ে একজন শ্রমিক তার পরিবারের জন্য কতটা সহায়ক হবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শেষ পর্যন্ত চা শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামের সফলতা হিসেবে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোন পথ নেই। গত ৯ আগস্ট ১২০ টাকা থেকে চা শ্রমিক মজুরি দৈনিক ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলনে নামেন চা শ্রমিকরা। সেদিন থেকে চার দিন পর্যন্ত দুই ঘণ্টা করে কর্ম বিরতি পালন করেন তারা। এরপর তারা ১৩ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পুরো-দমে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করেন। এ আন্দোলনের সাথে সারা দেশবাসী সংহতি প্রকাশ করলেও সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেন নি। শেষ পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে ২৭ আগস্ট বিকেলে চা বাগান মালিকদের সাথে আলোচনা করে দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্য চা শ্রমিকদের বেতন নূন্যতম হলেও চা শ্রমিকদের বিভিন্ন সুবিধা দেন চা বাগান মালিকরা। ব্রাকিং বোনাস ,বার্ষিক ছুটির ভাতা, বেতন সহ উৎসব ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি বর্তমান মজুরি বৃদ্ধির ফলে এসব সুবিধা আনুপাতিক হাড়ে বাড়বে। অন্যদিকে ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা ,কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা ও আনুপাতিক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া রয়েছে ভর্তুকি মূল্যে রেশন, যেটা ২৮ টাকা দিয়ে কিনে ২ টাকায় দেওয়া হয় শ্রমিকদের।চিকিৎসা সুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে কত টাকার সুবিধা একজন চা শ্রমিক পাবেন, তা তাৎক্ষনিক ভাবে নিরূপণ করা না গেলেও আশা করা যাচ্ছে সেটি দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকার সুবিধা পাবেন।
চা শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসেও শ্রমিকদের মজুরি ১৬৮ টাকা হয় নি। চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত প্রতি ২ বছর অন্তর ১/২ টাকা করে মজুরি বৃদ্ধি করা হতো। চা শ্রমিক সংঘের ভূমিকায় জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৮ সালে মৌলবি বাজার-হবিগঞ্জের ২০/২৫ টি বাগানে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের ফলে মজুরি বোর্ড গঠন করে এবং একধাপে ১৫.৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ৩২.৫০ টাকা হতে ৪৮ টাকায় মজুরি উন্নীত হয়। পরবর্তীতে দালালদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে¦ ইউনিয়নের অকার্যকারিতা এবং চা শ্রমিক সংঘের নেতৃত্বে সিলেট ভ্যালিতে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের কারণে ২০১২ ২০১৩ সালে প্রতি বছর ৭ টাকা করে মজুরি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। এ সময় সিলেট ভ্যালিতে বাগানে বাগানে স্থানীয় দাবি আদায়ের ধারাবাহিকতায় কাল-গুল বাগানে মালিক, সরকারি দল ও প্রশাসনের সর্বাত্মক আক্রমণ মোকাবেলা করে দীর্ঘ ৫ মাসের লাগাতার ধর্মঘট চা-শিল্পের আন্দোলনের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। চা শ্রমিক ইউনিয়নের অচলাবস্থা নিরসনে মালিক ও সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে ২০১৪ সালে বেআইনি ভাবে নির্বাচন করে কায়েমি স্বার্থনে¦ষী দালালদের প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। এরপর মালিকের দালালরা ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন দফায় যথাক্রমে ১৬ টাকা ১৭ টাকা, ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে মজুরি ১২০ টাকায় নিয়ে আসে। আর এবার তা বেড়ে ১৭০ টাকা হলো।
চা শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমের বিনিময়ে বাগান মালিকরা তাদের বিলাস বহুল জীবন যাপন করেন। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নের ব্যাপারে নির্বিকার। বরং শ্রমিক অধিকারে কোনো আন্দোলন গড়ে না ওঠে তার জন্য তারা শ্রমিকদের মাধ্যমে দালাল পোষেন। যে টাকায় তারা দালাল পোষেন সে টাকায় শ্রমিক কল্যাণ করা যেতে পারে। অথচ তারা তা করে না। তাই মালিকদের শ্রমিক বান্ধব হওয়া খুব জরুরি। শেষ পর্যন্ত দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি ও শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন এটা আশার কথা। আমরা শ্রমিক শোষণ চাই না, চাই শ্রমের মর্যাদা।