১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তার বাবা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁও ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। মায়ের নাম সুন্দরী বেগম। কিশোর বয়সে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কলকাতার প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের শিষ্যত্বে ৭ বছর সরগম সাধন করে যন্ত্রসংগীত সাধনায় নিযুক্ত হন। মূলত এরপর থেকেই তিনি ভারতে বসবাস শুরু করেন। তবে তার বাবা-মা বাংলাদেশেই থেকে যান।
প্রায় দেড়শ বছর আগে সুর স¤্রাট আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মা মৃত্যুবরণ করেন। তাদের শিবপুরে নিজ বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। বিগত দেড়শ বছর যাবত অরক্ষিত ও অবহেলায় ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মায়ের কবর। সেখানে কুকুর ঘুমানোর ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এনিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অবশেষে দেড়শ বছর পর জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলাউদ্দিন খাঁর বাবা-মায়ের কবর সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ইতিহাসে বিভিন্ন গ্রন্থ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাঙালির এমন এক সুরসাধক যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে পরিচিত ও প্রচার ও সমাদৃত করেন। তার সঙ্গীতগুরু ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভাসঙ্গীতজ্ঞ তানসেনের কন্যাবংশীয় রবাবী ওস্তাদ কাশিম আলী খাঁ। তিনি সঙ্গীতজগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন, যা ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। যোগ্য শিষ্য তৈরি তার এক বিশাল কীর্তি।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তালিমের গুণে তার ছেলে সরোদশিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খান বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ লাভ করেন। তার জামাতা সেতারশিল্পী প-িত রবিশঙ্কর বিশ্বখ্যাত হয়েছেন এবং ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ‘ভারতরতœ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের মাইহারেরই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনাবসান ঘটে। সেখানে তার কবর রয়েছে।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুরে এখনো রয়েছে তার মা-বাবার কবর। কবরটি অযতœ ও অবহেলায় পড়েছিল। তাদের কবরের সঙ্গে রয়েছে আলাউদ্দিন খাঁর এক বোনের কবরও। তাদের মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পর কবরটি সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। তার নামে গড়ে উঠেছে শিবপুর ওস্তাদ আলাউদ্দি খাঁ কলেজ। সেই কলেজে তার ইতিহাস সম্বলিত ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নিজ অর্থে একটি পুকুর খনন করে এক পাড়ে একটি মসজিদ তৈরি করে গিয়েছিলেন। মসজিদটিও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে।
মসজিদটি তত্ত্বাবধান করেন আলাউদ্দিন খাঁর বংশের নাতি খুরশেদ আলম খাঁ। তিনি বলেন, আমার দাদার মা-বাবার কবর প্রায় দেড়শ বছর অরক্ষিত-অবহেলায় ছিল। সংস্কার করার পর কবরটি খুব সুন্দর লাগবে। মসজিদটি দেখাশোনা আমি করি, এটিও সংস্কার করা হয়েছে৷
স্থানীয় সাংবাদিক হেদায়েত উল্লাহ বলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর অনেক সম্পদ বেদখল হয়ে গেছে। এগুলো উচ্ছেদ করে কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি জানাই।
সুর স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সভাপতি রানা শামীম রতন বলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মারা যাওয়ার পর এই স্থানটির করুণ পরিণতি ছিল। ইউএনও একরামুল সিদ্দিকীর একান্ত প্রচেষ্টায় ম্যুরাল তৈরি ও কবরটি সংস্কার করা সম্ভব হয়েছে। আমার দাবি এখানে তার নামে স্মৃতি কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হোক। তার যাবতীয় জিনিস ভারতে সংরক্ষিত আছে। আমরা চাই সেইসব জিনিস ফিরিয়ে এনে একটি যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হোক।
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একরামুল সিদ্দিকী বলেন, আমি যোগদানের পর শিবপুরে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িতে যাই। গিয়ে দেখি তার বাবা-মার কবর পুকুরে হেলে পড়ে আছে। আর কুকুর ঘুমিয়ে আছে। তেমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। এরপর আমি ম্যুরাল তৈরি ও কবরস্থানটি সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমাদের আরও অনেক পরিকল্পনা আছে। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।