সারা দেশের ন্যায় আগামী ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উত্তরের রংপুর জেলা পরিষদের নির্বাচন। এরইমধ্যে শুরু হয়েছে নির্বাচনী হাওয়া, সর্বত্রই চলছে আলোচনা। রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য দলীয় প্রার্থীদের আমলনামা নিয়ে চলছে নানা মূল্যায়ন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন ও দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিমতের ভিত্তিতে হতে পারে প্রার্থী বাছাই।
এরই মধ্যে রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী দেড় ডজন নেতা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। যে যার মতো দলীয় মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অনেকেই ঢাকায় গিয়ে কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতাদের দারস্থ হচ্ছেন। অনেকেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। সর্বত্রই এখন আলোচনা চলছে কে হচ্ছে জেলা পরিষদের পরবর্তী কা-ারী বা চেয়ারম্যান।
তবে জাতীয় পার্টি ও বিএনপিসহ অন্য দল গুলো এবারের জেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিবে কি না তা এখনও জানা যায়নি। যদি নির্বাচনে তারা অংশ না নেয় তার পরেও এ জেলায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভোট পেতে কাটখড় পোড়াতে হবে বলে ধারণা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে স্থানীয়রা সচেতন মহল ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা চায় কেন্দ্র থেকে ক্লিন ইমেজ, সৎ, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হোক।
রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি এ্যাড হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, ড.ওয়াজেদ মিয়ার ভাতিজা ও জেলা সহ-সভাপতি একেএম শাহাদাত হোসেন বকুল, বর্তমান জেলা প্রশাসক এ্যাড ছাফিয়া খানম, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইলিয়াস আহমেদ ও আরেক সহ-সভাপতি রোজী রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন মওলা, রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু, রংপুর চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল কাশেম, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এ্যাড দিলশাদ ইসলাম মুকুল, শাহ নবী উল্লাহ পান্না, শামীম তালুকদার, রেজাউল করিম মিলন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম প্রামাণিক, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা লতিফুর রহমান মিলন ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য পারভীন আক্তার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুর জেলার একটি সিটি করপোরেশন, তিনটি পৌরসভা, আট উপজেলা এবং ছিয়াত্তরটি ইউনিয়ন মিলে ভোট জনপ্রতিনিধি ভোটার সংখ্যা ১ হাজার ৯৫ জন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছে। জেলায় মিঠাপুকুর উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের ৯জন ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন। এর বাহিরে পীরগাছায় ৪ জন ও তারাগঞ্জে এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ জেলায় বেশ কিছু ইউপি সদস্য বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত রয়েছেন। এছাড়াও সিটি কর্পোরেশনসহ তিন পৌরসভায়ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধি রয়েছে আওয়ামী লীগের বাহিরে অন্য দল থেকে নির্বাচিত। তারা ভোটের মাঠে ‘ফাক্টর’ হয়ে দাঁড়াতে পারেন। তাই এবারের জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী হতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে সহজ রাস্তায় হাটলে হবে না। তাদের ভোটরে মাঠে বিজয় অর্জন নিশ্চিত বলা যাবে না।
তবে রংপুর আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, রংপুর জেলা পরিষদ দেশের অন্যতম একটি জেলা পরিষদ। যে টি বিভাগীয় ‘হেড কোয়ার্টারে’ অবস্থিত। একারণে এখান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কে হবেন তা গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। তবে বিএনপি-জামায়াতের জনপ্রতিনিধিদের ভোট তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। এজন্য কেন্দ্র থেকেই ক্লিন ইমেজের সৎ ও যোগ্য এবং সাংগঠনিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত রংপুরে দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের রাজনৈতিক সাংগঠনিক ভিত্তি কিছুটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া জেলা-উপজেলার পর্যায়ের শীর্ষ নেতাকর্মীরা দলের আদর্শের চেয়ে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার অনুসারী। সে কারণে যেখানে যার প্রভাব বেশি তিনি বেশি সেখানে শক্তিশালী। দলের কেন্দ্রীয় কমান্ডের বিষয়টি এখানে গুরুত্বহীন। এই পরিস্থিতিতে জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনিশ্চিত অবস্থায়। কারণ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন দলের সাথে কতটুকু দরকষাকষি করে করে কতটি জেলা পরিষদের প্রার্থী আদায় করে নিতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করবে প্রার্থী নির্বাচন।
জাতীয় পার্টির পক্ষে যাদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন, দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান এসএম ইয়াসির, জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, কেন্দ্রীয় সদস্য লোকমান হোসেন, জাতীয় আইনজীবী ফেডারেশনের বিভাগীয় যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মোকাম্মেল হক চৌধুরী ও পীরগাছা উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ মাহবুব রহমান।
এছাড়াও জাসদ, বাসদ, সিপিবি বা অন্য দলগুলোর তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এসব দলের প্রার্থী দিবে কি না তাও অনিশ্চিত।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তারা এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ নিবে না। ২০১৬ সালের প্রথম নির্বাচনেও দলটি অংশ নেয়নি। তবে দলের একটি সূত্র জানায়, বিএনপি’র পক্ষে নির্বাচনের জন্য গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকেই। তবে তারা দলীয় হাইকমান্ড এর সিদ্ধন্তের অপেক্ষা করছেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, দলীয় সাংগঠনিক কর্মকা- ও বিভিন্ন জরিপে যাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে তারাই দলের সমর্থন পাবেন। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর মনোনয়ন বোর্ডের সভায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। ওই দিন গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় সরকার জনপ্রনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথ সভায় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।
এব্যাপারে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদের প্রশাসক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন চাইবেন। দল যদি তাকে মনোনয়ন দেন তা হলে তিনি নির্বাচন করবেন। নির্বাচিত হলে উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন। তিনি আশাবাদী দল তাকে মূল্যায়ন করবে।
চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা পরিষদের বর্তমান প্রশাসক এ্যাড ছাফিয়া খানম জানান, তিনি আগে চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তিনি আশাবাদী দল তাকেই মনোনয়ন দিবে।
রংপুর চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কোষাধ্যক্ষ আবুল কাশেম জানান, তিনি রংপুরের মানুষের জন্য কাজ করতে চান। রংপুরে উন্নয়ন তরান্বিত করার আশায় আমি মনোনয়ন প্রত্যাশী।’ আশাকরি দল মূল্যায়ন করবে।
বিএনপি নেতারা বলেন, এখন তারা জ¦ালানী তেলসহ দ্রব্য মুল্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন। আওয়ামী সরকার দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। হামলা-মামলা করছে। অনেকে বাড়ি-ঘর ছাড়া। তাই এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবেন না। ২০১৬ সালের প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশ নেয়নি বিএনপি।
রংপুর জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাজী আবদুর রাজ্জাক বলেন,“ জাতীয় পার্টি জেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবো কিনা সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। যদি কেন্দ্র থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসে তবে আমরা জানাবো।”
উল্লেখ্য, আগামী ১৭ অক্টোবর তিন পার্বত্য জেলা বাদে সারাদেশের ৬১টি জেলা পরিষদের ভোটগ্রহণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৫ সেপ্টেম্বর, মনোনয়ন পত্র বাছাই ১৮ সেপ্টেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৫ সেপ্টেম্বর, প্রতীক বরাদ্দ ২৬ সেপ্টেম্বর।