দশ বছর বয়সী লামিয়া আক্তার। জন্মের পর থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় কখনো দু’পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। এই অসহায় শিশুর চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্যও নেই তার মা-বাবার। অভাব অনটনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। এ কারণে লামিয়ার মা-বাবা তাদের একমাত্র কন্যাসন্তানকে বুকে আগলে রাখলেও মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি। দীর্ঘদিনেও পারেনি লামিয়ার ইচ্ছাপূরণে একটি হুইল চেয়ার কিনে দিতে।
অবশেষে সেই লামিয়ার মুখে হাসি ফুটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেখে লামিয়ার জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছেন মানবিক পুলিশ শেখ মোস্তাফিজুর রহমান। রংপুর সদর কোর্টের সহকারি টাউন সাব-ইন্সপেক্টর (এটিএসআই) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন এই পুলিশ সদস্য।
সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রংপুর কোর্ট চত্বরে শিশু লামিয়ার মা কমলা বেগমের কাছে একটি উন্নতমানের হ্ইুল চেয়ারসহ খাদ্য সামগ্রী ও নগদ অর্থ প্রদান করেন ওই পুলিশ সদস্য। এ সময় সেখানে শিশু লামিয়া ছাড়াও বিজ্ঞ আইনজীবী মিন্নাত খানম মুক্তা, কোর্ট ইন্সপেক্টর আনিছুর রহমান, সাংবাদিক তপন কুমার দাসসহ বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের বালারপুকুর বাশদহ গ্রামের মোহাম্মদ দুলু মামুদ ও কমলা বেগম দম্পতির একমাত্র কন্যা শারীরিক ও বাকপ্রতিবন্ধী লামিয়া আক্তার। জন্মের কয়েকমাস পর লামিয়ার শারীরিক অসুস্থতা বুঝতে পারেন তার পরিবার। কিন্তু অর্থাভাবে কোনো চিকিৎসা করাতে পারেননি। একাই চলাফেরা করতে না পারা লামিয়া কথাও বলতে পারেন না। অন্যের হাত ধরে নয়তো কোথাও ভর করে হাঁটতে হয় লামিয়াকে। নিজে থেকে মুখে খাবার তুলে খেতেও পারে না।
লামিয়ার বাবা দুলু মামুদ ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। আর স্ত্রী কমলা বেগম গ্রামে দুই সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে কাজও করেন। আর্থিক দৈন্যদশায় শারীরিক প্রতিবন্ধী লামিয়ার চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ মা-বাবার কষ্ট তুলে ধরে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লামিয়ার ছবিসহ একটি পোস্ট দেন জলঢাকার স্থানীয় সংবাদকর্মী তপন কুমার দাস। গত ৩ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া পোস্টটিতে শিশু লামিয়ার জন্য একটি হুইল চেয়ারের আবেদন করা হয়। সেই পোস্টটি নজরে আসে রংপুর সদর কোর্টের এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজুর রহমানের। এরপর তিনি ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে লামিয়াকে একটি হুইল চেয়ার প্রদান করেন।
এ ব্যাপারে লামিয়ার মা কমলা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার দুটি ছেলে-মেয়ে। এরমধ্যে সবার বড় লামিয়া, ছোট ছেলে কাওছারের বয়স পাঁচ বছর। জন্মগতভাবে লামিয়া শারীরিক প্রতিবন্ধী। আমার স্বামী রিকশাচালক। মেয়ের চিকিৎসা করার মতো আমাদের সামর্থ্য নেই। আমি নিজেও অন্যের বাড়িতে কাজ করি। খুব কষ্টে আমাদের সংসার চলছে। এখন মেয়ে লামিয়া বড় হওয়ার সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে হাঁটাচলা বা খেতেও পারে না। অন্য কারো হাতেও খায় না। দিন দিন মেয়েটার শারীরিক অন্য সমস্যাও দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বৃত্তবান মানুষদের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই। একটা হুইল চেয়ারের জন্য ইউপি চেয়ারম্যানসহ কতজনকে বলেছি, কেউ ব্যবস্থা করে দেয়নি। এক সাংবাদিক ভাই আমার মেয়ের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছিল। এরপর পুলিশ ভাই আমার মেয়েকে হুইল চেয়ার দিয়েছে। মেয়ে এখন খুশি।
এদিকে রংপুর কোর্ট পুলিশের এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজ রহমান বলেন, আমি ফেসবুকে পোস্ট দেখার পর ওই পরিবারের খোঁজ খবর নিয়ে প্রতিবন্ধী লামিয়াকে একটু সহযোগিতা করে তার পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমি আমার নিজ উদ্যোগে অবসর সময়ে সামর্থ্য অনুযায়ী এসব মানুষদের সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করছি। আমার মনে হয় আমরা সবাই যদি সবার জায়গা থেকে একটু একটু এগিয়ে আসি, তাহলে সমাজে অসহায় গরীব মানুষেরা দুঃখ কষ্ট ভুলে একটু ভালো অবস্থায় ফিরতে পারবে।
তিনি বলেন, চাকরি জীবনের ২২ বছর চলছে। এরইমধ্যে সিরাজগঞ্জ, ডিএমপি, দিনাজপুর, রাঙ্গামাটি, গাজীপুর ও পঞ্চগড়ে কর্মরত থাকাকালীনও এমন গরীব দুঃখী ও অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। আমি চার বছর আগে ফুড ব্যাংক বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছি। এ ধরণের মানবিক কাজ করতে আমার ভালো লাগে। আত্মার মধ্যে অন্যরকম শান্তি পাই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এটিএসআই শেখ মোস্তাফিজ রহমান ২০০০ সালে পুলিশে যোগদান করেন। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মানবিক কাজ করে আসছেন। ২০২০ সালে গাজীপুরে হাইওয়ে পুলিশে থাকাকালীন ঘুষ বিরোধি সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন।