বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য এখন খুলনার পাইকগাছায় জেলে পল্লীগুলোতে তোড়জোড় চলছে। মহাজনের চড়াসুদে দাদনে টাকা নিয়ে জীবিকার তাগিতে আশা-নিরাশায় সাগর যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে জেলেরা। নতুন তৈরি এবং পুরাতন ট্রলারটি মেরামত, জাল বুনোন ও শুকানোর কাজের ধুম পড়েছে। জেলে পল্লীর নারী-পুরুষ ও শ্রমিকরা সুন্দরবনের দুবলার চরে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার পস্তুতির মধ্য বিরাজ করছে তাদের সারা বছরের জীবিকা অর্জনের আশার সাথে রয়েছে হতাশাও। উপজেলায় বোয়ালিয়া, হিতামপুর, মাহমুদকাটী, নোয়াকাটি, কপিলমুনি, কাটিপাড়া, রড়-লী, শাহাপাড়া, বাঁকাসহ বিভিন্ন গ্রামের জেলে পল্লী থেকে প্রায় ২৫০টি ট্রলার সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের কাজে বাড়ীর ছোট বড় সবাই সহযোগীতা করছে। নতুন ট্রালার তৈরি, পুরাতন ট্রলারগুলো সংস্কার, জালবুনোন, লোহার নোঙ্গর/গ্রাফি, ট্রলারের রং করা, জালে গাবকুটে তার রস লাগানো সহ সমুদ্রে যাওয়ার বিভিন্ন কাজ নিয়ে জেলে পল্লীর নারী-পুরুষরা এখন ব্যস্ত। উপজেলায় জেলাপাড়ার নারী-পুরুষ সকলেই সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কাজ নিয়েও ব্যস্ত। বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় ৩টি নতুন ট্রলার তৈরী করা হচ্ছে। মিস্ত্রীরা দিন রাত ট্রলার তৈরী কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ট্রলার তৈরীসহ সকল প্রস্তুতি নিয়ে মালোপাড়ায় এখন উৎসব মূখর পরিবেশ। জেলে রবিন বিশ্বাস, প্রজিৎ বিশ্বাসসহ কয়েক জন নতুন ট্রলার তৈরী করছেন। তাছাড়া দিপংকর বিশ্বাস, সিতেরাম বিশ্বাস, তাপস বিশ্বাস, দয়াল মন্ডল তাদের পুরাতন ট্রলারগুলি মেরামত করছে। কপোতাক্ষ নদের তীরে বোয়ালিয়া ব্রিজের দুই পাশে ট্রলার তৈরী ও মেরামতের কাজ চলছে। বোয়ালিয়া মালোপাড়ার বিশ্বজিত বিশ্বাস এফএনএসকে জানায়, সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে ১টি ট্রলার তৈরি করছি। নতুন ট্রলার তৈরী করতে সর্বমোট খরচ পড়ছে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা। মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়েছে। সাগরে মাছ ধরে তা বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করবেন। ট্রালার তৈরি করতে বিভিন্নস্থান থেকে মিস্ত্রী আনতে হয়েছে। মাহমুদকাটির ইন্দ্রজিতসহ ৫ জন সহকারি মিস্ত্রী ট্রলার তৈরি করছেন। ট্রলার তৈরিতে মিস্ত্রীদের থাকা খাওয়া বাদে প্রতিটি নতুন ট্রলার তৈরী বাবদ মজুরী ১ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ৬০ ফুট লম্বা ১৭ ফুট চওড়া একটি ট্রলার তৈরি করতে প্রায় ৫শ সেফটি কাঠ লাগে। সব কাঠ দিয়ে ট্রলার তৈরি হয় না। এলাকায় পাওয়া যায় এমন চম্বল, বাবলা, লিছু, সবেদা, মেহগনী ও খৈ কাঠ দিয়ে তারা ট্রলার তৈরি করছে। প্রতি সেফটি খৈ বাবলা ও চম্বল কাঠ ৬শ টাকা থেকে ১৫শ টাকা দরে ক্রয় করা হয়েছে। নতুন ট্রালার তৈরির পর তাতে রং করতে প্রায় ২শত কেজি আলকাতরা লাগে। পুরাতন ট্রলার মেরামত করতে ২০-৭০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। একটি নতুন ট্রলারে প্রায় ৩ মন পেরেক, ১শ কেজি জলই/পাতাম প্রয়োজন হয়। ট্রালার তৈরি পর ইঞ্জিন বসাতে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ২টি করে নোঙ্গর প্রয়োজন হয়। লোহার তৈরী নোঙ্গর তৈরী করতে খরচ পড়ে ২৮ হাজার টাকা। প্রতিটি মাছ ধরার জাল তৈরি করতে তাদের খরচ হচ্ছে ৯০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য প্রতি ট্রলারে ২টি জাল প্রয়োজন হয়। প্রতি ট্রলারে জাল ধরার জন্য ৮/১০ জন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়। তাদের থাকা-খাওয়া বাদে প্রতি মাসে ১০/১২ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য ট্রলার প্রতি ৫/৬ মাসে সব কিছু মিলে খরচ পড়ে প্রায় ৭/৮ লাখ টাকা। জেলে সিতেনাথ বিশ্বাস এফএনএসকে জানান, সাগরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। ৫ থেকে ৬ মাসের জন্য দুবলার চরে অস্থায়ী জেলে পল্লীতে বাসা বেধে থাকা ও মাছ শুকানোর আড়ত তৈরী করতে হয়। এর জন্য অনেক টাকার দরকার হয়। সব টাকা নিজের না থাকায় এলাকার বিভিন্ন মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা দাদন নিতে হয়। ৫ থেকে ৬ মাসের জন্য তারা দাদন নিলেও বছর হিসাবে টাকা দিতে হয়। প্রতি ১ লাখ টাকায় মহাজনদের প্রতি মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। জেলে পাড়ার অজয় বিশ্বাস এফএনএসকে জানান, সরকার আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের ব্যবস্থা করত তাহলে মাছ ধরে উপার্জিত টাকা ঘরে ফিরে আনতে পারতাম। তা না হলে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া চড়া সুদের টাকা শোধ করার পর উপার্জিত টাকা ঘরে ফিরে আসে না। জেলেরা বিভিন্ন মহাজনের অধীনে থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। মহাজনরা জেলেদের পাস পারমিট করে রাখে। মোংলা থেকে পাস নিয়ে জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য দুবলার চরে রওনা দেয়। মোংলা হয়ে বলেশ্বর নদী দিয়ে দুবলার চরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে মোংলা ঘুরে দুবলার চরে যেতে পাইকগাছার জেলেদের প্রায় ৩ দিন বাড়তি সময় লাগে এবং খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুন। সমুদ্রে যাওয়া জন্য বন বিভাগ থেকে পাশ পারমিট নেয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছে। সব কিছু ঠিক থাকলে দুর্গাপূজা শেষে জেলেরা মাছ ধরার জন্য সুন্দরবনের দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন। বন সুরক্ষার জন্য বনের ১৩টি চর নিয়ে জেলেরা যে মৎস্য পল্লী তৈরি করে তা এ বছর সীমিত করা হতে পারে বলে জানা গেছে। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানাগেছে, বঙ্গোপসাগর উপকূলে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। পূর্ব বন বিভাগের অধিনে দুবলা তাই জেলেদের পূর্ব বন বিভাগ থেকে পাশ পারমিট নিতে হবে। পহেলা নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলে বন বিভাগ সে মত সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। বোয়ালিয়া জেলে পল্লীর জেলেরা দুর্গাপূজার পর উপজেলার সকল ট্রলার এক সঙ্গে রওনা দিবেন। মোংলা হয়ে সুন্দরবনের দুবলার চরে গিয়ে বাসা বেঁধে অবস্থান নিবে। জীবিকার জন্য প্রতি বছর সুমুদ্রে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বনদস্যু ও জলদস্যুদের সাথে জেলেদের জীবন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। মাছ ধরার জন্য গভীর সমুদ্রে ভয়ংকর, বিক্ষুদ্ধ উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরতে হয়। তবে এটা জেনেও তাদের নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত বিপদের সঙ্গে লড়াই করে তাদের জীবিকা অর্জন করতে হয়। তাই জেলে পল্লীর নারী-পুরুষ সবাই মিলে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র তৈরী ও গোছাতে দিন রাত কাজ করছে। সব মিলিয়ে জেলে পল্লীগুলোতে সাগর যাত্রার মহাকর্মযজ্ঞের তোড়জোড় চলছে।