প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল বা পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনকাল থেকে কনস্টান্টিনোপলের পতন ও পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের অবলুপ্তি পর্যন্ত কালকেই ইতিহাসে মধ্যযুগ হিসাবে ধরা হয়। এই সময়ে রোমের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পতন ঘটায় পুরো ইউরোপজুড়ে সৃষ্টি হয় অরাজকতা। শক্তিশালী সাম্রাজ্য পরিণত হয় খণ্ড খণ্ড রাজ্যে এবং অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় শাসকদের ক্ষমতার পরিধি সীমাবদ্ধ থাকে শুধু রাজপ্রাসাদের আশপাশ এলাকায়। দারিদ্র ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে তখন সাধারণ মানুষের প্রাণ ছিল ওষ্ঠাগত। সম্পদ ও পৃষ্ঠপোষকের অভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রেও তখন শুরু হয় অধোগতি। কিন্তু ইসলাম ধর্ম এ সময় সংহতির নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠায় নিকট প্রাচ্যে শিক্ষাদীক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। অন্যদিকে এশিয়া ও আমেরিকায় বিকাশ লাভ করতে থাকে জটিল প্রকৃতির স্বাধীন সভ্যতা।
তবে ইউরোপের চিত্র দীর্ঘকাল অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকেনি। ধীরে ধীরে সেখানে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং শক্তিশালী রাজারা তাদের রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। এ সময় সামন্তপ্রথা প্রবর্তনের ফলে সরকার ব্যবস্থার একটি ভিত গড়ে ওঠে। পরিশেষে চার্চের অব্যাহত ক্ষমতা বৃদ্ধি ও সম্পদ সমাজের আরেকটি নিয়ামক শক্তি হিসাবে পরিগণিত হয়; ফলে এক শ্রেণীর মানুষ বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানান্বেষণের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সন্ন্যাসী
মধ্যযুগে সারা ইউরোপ জুড়ে স্থাপিত মঠগুলো ছিল জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল। এছাড়াও এগুলো ছিল গরিব দুঃখীদের জন্য তো বটেই ধনী ভূমিমালিকদেরও বিপদে-আপদে সাহায্য পাওয়ার কেন্দ্র। অনেক এলাকায় এই মঠগুলো ছিল চার্চের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক শক্তির অন্যতম প্রভাবশালী উৎস।
পার্থিব জগতের বদলে ঈশ্বরের উপাসনায় নিয়োজিত থাকার লক্ষ্যে সন্ন্যাসবাদের ধারণা খ্রিস্টের আগেই এশিয়ায় গড়ে উঠেছিল। প্রথম দিকের যেসব খ্রিস্টান এই ধারণা বা মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন তার নির্জনে তাপস জীবনযাপন করতেন। তিনশ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিসরীয় তাপস থিবিসের সেন্ট অ্যান্টনি কয়েকজন তাপসকে নিয়ে একটি সংঘ গঠন করেন। তার দেখাদেখি শীঘ্রই অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরাও গঠন করেন অনুরূপ সংঘ। একজন ধর্মীয় নেতার অধীনে কতকগুলো সংঘ একই নিয়ম পালন করত। এসব সংঘের জন্য সর্বশেষ নিয়ম রচনা করেছিলেন নুরসিয়ার সেন্ট বেনেডিক্ট; তিনিই ৫২৯ সালের দিকে ইতালিতে মন্টি ক্যাসিনো মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেনেডিক্ট নির্দেশ দেন যে, একজন সন্ন্যাসীকে প্রার্থনা ছাড়াও কায়িক শ্রম করতে হবে। কিন্তু পোপ ষষ্ঠ গ্রেগরির নির্দেশনা অনুসারে কিছু সন্ন্যাসী প-িত ও শিক্ষক হয়ে ওঠেন। মানুষ তখন তেমন লেখাপড়া জানত না, তারাই ধরে রেখেছিলেন প্রাচীন জ্ঞান ও বিদ্যা। তা না হলে জ্ঞানের এ সম্পদ তখনই বিলুপ্ত হয়ে যেত। সন্ন্যাসীরা মৃতের আত্মার যেমন সদগতি কামনা করতেন তেমনি পীড়িতের সেবা ও গরিবের অন্ন জোগাতেন। এই মঠগুলো তখন হয়ে উঠেছিল চিকিৎসার অন্যতম কেন্দ্র।
মধ্যযুগের ইউরোপে মঠগুলো এছাড়াও ভ্রমণকারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করত, কার্যত এগুলো ছিল প্রথম আধুনিক রেস্ট হাউস বা আশ্রয়নিবাস। ফ্রান্সের ক্লনির এ্যাবে একবার নবম লুইয়ের পারিষদবর্গ ও পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টের পারিষদবর্গকেও আপ্যায়িত করেছিল। ছোট ছোট মঠগুলো অবশ্য পথিকদের জন্যই থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করত।
হজরত মুহম্মদ (স:) ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (স:) সৌদি আরবের মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মের আগেই পিতা এবং জন্মের ৬ বছর পর মাতাকে হারান। প্রথমে তিনি দাদা ও ৮ বছর বয়স থেকে চাচার কাছে লালিত-পালিত হন। শৈশবে তিনি সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মাঠে মেষ ও উট চরাতেন। এরপর তিনি ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হজরত খাদিজার (রা:) ব্যবসায়িক কাজে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীকালে তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
হজরত মুহম্মদের (স:) বয়স যখন ৪০ বছর তখন ফেরেশতা জিবরাঈল (আ:) তাঁকে সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহর কথা প্রচারের আদেশ দেন। এরপর তিনি মক্কায় ধর্ম প্রচার শুরু করেন। এতে এক শ্রেণীর লোক তার বিরোধিতা শুরু করে এবং তার ওপর নির্যাতন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে একপর্যায়ে তিনি ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে নিকটবর্তী শহর মদিনায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। মদিনা পরে পরিচিত হয়ে উঠে নবির শহর হিসাবে। তার এই মক্কা থেকে মদিনায় চলে আসার দিন থেকে মুসলিম দিনপঞ্জির ‘হিজরি সন গণনা শুরু হয়।
মদিনায় হজরত (স:)-এর অনুসারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ৬৩০ সালে তিনি জন্মভূমি মক্কায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। এবার তিনি এখানে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং নির্দেশ দেন যে অবিশ্বাসীরা কখনও এই শহরে প্রবেশ করতে পারবে না। আজও কেবলমাত্র মুসলমানদেরই সেখানে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে।
হজরত মুহম্মদ (স:) তার অনুসারীদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে যেসব নির্দেশনা দিতেন তারই লিখিত রূপ হচ্ছে কোরান যা ইসলামের পবিত্রগ্রন্থ। তিনি তাঁর অনুসারীদের জানিয়ে দিতেন যে, এগুলো তার শিক্ষা নয় বরং এগুলো ঐশীবাণী, যার মুখপাত্র ও নবি তিনি।
ইসলাম শুধু একটি মহৎ ধর্মই নয়, এটি ছিল একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহম্মদের (স:) ইন্তেকালের সময়ই সমগ্র আরবজাহানে ইসলাম তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং আফ্রিকা ও এশিয়ায় এই ধর্ম বিস্তার লাভ শুরু করে।