বিদেশি জাতের বিশালদেহী পাঁঠার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু দিচ্ছেন, পিঠে হাত বুলিয়ে কাঁঠালের পাতা খাওয়াচ্ছেন আবার ওদের সঙ্গে কথা বলছেন, কখনো বা গান শোনাচ্ছেন আবার নিজেই সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন। এটি তৃতীয় লিঙ্গের রত্নার পাঁঠার খামারের নিত্যদিনের চিত্র। সাদিয়া আক্তার রত্না ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বলিদাপাড়ার বাসিন্দা। তিনি সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন একেবারে ব্যতিক্রম ভাবে। স্বাবলম্বী হতে নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন পাঁঠার খামার। যা আশপাশের জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় পাঁঠার খামার হিসেবে পরিচিতি।
কালীগঞ্জ থানার গুরুমা হিসেবে পরিচিত রত্না। শখের বসে ২০০৮ সালে রাজশাহী থেকে ১ লাখ টাকায় দুটি পাঁঠার বাচ্চা কেনেন তিনি। চট্রগ্রামে পাঁঠার হাটে ঘুরতে গিয়ে তার মাথায় আসে খামারের চিন্তা। বাড়িতে ফিরে শুরু করেন দুটি শেড তৈরির কাজ। তারপর রংপুর, রাজশাহী ও দিনাজপুর থেকে হরিয়ানা, তুতাপুরী, পাকিস্থানি, নেপালি ও ভুটানি জাতের ৫৬ টি পাঠা দিয়ে গড়ে তোলেন স্বপ্নের খামার। বর্তমানে তার খামারে ছোট-বড় মোট ১১৪টি পাঁঠা রয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। পাঁঠা গুলো গড়ে এক থেকে দেড় বছর লালন-পালন করে শ্রাবন মাসের ২০ তারিখ চট্টগ্রামের আকবর খানের হাটে নিয়ে বিক্রি করেন। তার খামারে ৮-১০ জন লোক কাজ করেন। পাঁঠাগুলোকে প্রতিদিন কাঁঠালের পাতা, ছোলা, ভুসি, বিটলবন, বিচুলি কুচি ও আখের গুড় মিশ্রিত পানি খাওয়ানো হয়। খামারে কোনো পাঁঠা অসুস্থ হলে রত্না নিজেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেন এবং পরবর্তীতে পশু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়।
কাজল নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজন বলেন, আমার সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের অন্যরা পাঁঠা দেখাশোনার জন্য কাজ করে। আমরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর গোয়ালটা সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করি। এরপর প্রথমে কাঁঠালের পাতা খাওয়ানো হয়। ১২টার দিকে আখের গুড় দিয়ে পানি খাওয়ানো হয়। দুপুরে গোসল করানোর পর ২টার দিকে ভুসি ও বিচুলি খেতে দেওয়া হয়। রাতে কাঁঠাল পাতা ও ছোলা খেতে দেওয়া হয়।
খামার দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত সমির বলেন, খামার দেখাশোনার জন্য আমরা ১০ জন কাজ করি। আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খামারের পাঁঠা গুলোকে দেখাশোনা করি। নিয়মিত গোসল করানোর কারণে পাঁঠার গায়ে কোনো গন্ধ হয় না। প্রতিদিন ৫০০ টাকা করে হাজিরা দেওয়া হয়। এতে আমাদের ভালোভাবেই সংসার চলে যায়। পাঁঠার খামারের মালিক রত্না বলেন, আমি তৃতীয় লিঙ্গের একজন মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বীকৃতি দিলেও আমাদের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। মানুষের কাছে হাত পেতে খাওয়া ভালো কাজ না। তাই আমি নিজ উদ্যোগে একটি পাঁঠার খামার গড়ে তুলেছি আমার খামার গড়ে তোলার পেছনে সরকারি-বেসরকারি তথা সমাজের কারোর কোনো সহযোগিতা পাইনি। আমাদের দেখে মানুষ উপহাস করে। কিন্তু আমাদের যারা উপহাস করে, তারা কত নিচে গিয়ে আমাদের নিয়ে উপহাস করে ? আমি তৃতীয় লিঙ্গের হওয়াই আমার খামার নিয়ে অনেকেই আজেবাজে মন্তব্য করেন। আমার বিরুদ্ধে এমপির কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। তারপরও আমি থেমে থাকিনি। শুনেছি ডিআইজি হাবিবুর রহমান স্যার তার উত্তরণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করছেন। আমরা তার কাছ থেকেও কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি।
কালীগঞ্জ উপজেলা প্রানি সম্পদ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. মামুন খান বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের একজন পাঁঠার খামার গড়ে তোলার ব্যাপারটি একেবারেই আলাদা। তিনি ২০১৬ সাল থেকে নিজের প্রচেষ্টায় পাঁঠার খামার গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। বর্তমানে তার খামারে ১১৪ টি পাঁঠা রয়েছে। আমাদের পৌরসভার ফিল্ড কর্মী প্রতি সপ্তাহে একবার সেখানে ভিজিট করেন এবং কোনো ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে প্রদান করেন। ভবিষ্যতে যদি সরকারি ভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকে, অবশ্যই আমরা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি হিসেবে ভিন্নধর্মী এই উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা করব।