কৌতূহল এবং অজানাকে জানার আকাক্ষা অংশত সব সময়েই অভিযানের পেছনে উদ্দীপনা জুগিয়ে এসেছে। কিন্তু ১৪০০ এর শতকে অভিযানের পিছনে ব্যাপকভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল বাণিজ্য। ওই সময়ে শীতকালে মাংসকে সংরক্ষণ এবং সুস্বাদু করার জন্য ব্যাপকভাবে মসলা ব্যবহার করা হত। এই মসলার জন্য ইউরোপ ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল প্রাচ্যের দ্বীপগুলো থেকে আমদানির ওপর; এখন যা মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। কিন্তু এই মসলা আসত নিকটপ্রাচ্যের ভিতর দিয়ে স্থলপথে এবং বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করেই কেবল তা কেনা যেত। সমুদ্রসন্ধানী প্রিন্স হেনরির সময় থেকেই পর্তুগিজ নাবিকরা ভারতে আসার জন্য সমুদ্রপথের সন্ধানে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে অভিযান চালিয়ে আসছিল। ১৪৮৭-৮৮ সালে প্রথম ইউরোপিয়ান হিসাবে বার্থোলোমিউ দিয়াশ উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে আসেন এবং দশ বছর পর ভাস্কো ডা গামার অভিযান পরিকল্পনায় তিনি সহায়তা করেন। ভাস্কো ডা গামা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেন এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলের কালিকটে পৌঁছেন। তাঁর এই সমুদ্রযাত্রাকে অনুসরণ করে বাণিজ্যযাত্রার নেতৃত্ব দেন পেড্রো আলভারেস ক্যাবরাল, যিনি মূল্যবান লঙ্কার চালান নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেন।
ভাস্কো ডা গামার এই সফল সমুদ্রযাত্রার পূর্বে ক্রিস্টোফার কলম্বাস স্পেনের রানি ইসাবেলাকে ভারতে যাওয়ার পশ্চিমমুখী সমুদ্রপথ খুঁজে বের করার অভিযানে অর্থ সাহায্য করতে রাজি করান। কলম্বাস প্রাচীন এবং ভ্রান্ত মানচিত্র ব্যবহার করেছিলেন এবং পৃথিবীটাকে তিনি এর সত্যিকার আয়তনের চাইতে ছোট ঠাউরেছিলেন। ১৪৯২ সালে তিনি আটলান্টিক পাড়ি দেন এবং একটি দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন যাকে তিনি ভারত (ইন্ডিজ) বলে অভিহিত করেন (বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ) এবং বিশ্বাস করেন যে তিনি তার লক্ষ্যে পৌঁছে গেছেন।
কলম্বাস বুঝতেই পারেননি যে, তিনি একটা নতুন মহাদেশই আবিষ্কার করে ফেলেছেন। এমনকি কলম্বাসের মৃত্যুর চার বছর আগে পরবর্তী এক অভিযানে গিয়ে আমেরিগো ভেসপুচি ১৪৯২ সালে যখন বলেন এটা অবশ্যই ভিন্ন এক মহাদেশ, তখনও কলম্বাস তা বিশ্বাস করেননি। ভেসপুচির মতকে সমর্থন করেন জার্মান মানচিত্রবিদ মার্টিন ওয়াল্ডসীমুলার। ১৫০৭ সালে তিনি বলেন এই নয়া দুনিয়ার নামকরণ করা উচিত আমেরিগোর নাম অনুসারে আমেরিকাণ্ড-যেহেতু তিনিই এটা আবিষ্কার করেছেন।
সমুদ্রপথে প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষিণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পর্তুগিজ সমুদ্র অনুসন্ধানী ফার্দিনান্দ ম্যাজিলান (১৪৮০-১৫২১)। তাঁর নিজের দেশের আনুকূল্য না পেয়ে ম্যাজিলান স্পেনকে তাঁর সেবা প্রদানের প্রস্তাব দেন। স্পেনের শাসক পঞ্চম চার্লস অভিযান পরিচালনার জন্য তাকে একটি নৌবহর প্রদান করেন।
১৫১৯ সালে ম্যাজিলান পাঁচটি জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ দিকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সেখানে তিনি পশ্চিমদিকের মহাসাগরে যাওয়ার একটি পথ খুঁজে পাবেন। প্রচ- ঝড় উপেক্ষা করে ম্যাজিলান যে নৌপথ খুঁজে বের করেন তার নাম অনুসারেই এটির নামকরণ করা হয়। এই পথ ধরে তিনি এক শান্ত সাগরে প্রবেশ করেন, যার নাম দেন তিনি প্রশান্ত মহাসাগর। এই যাত্রায় তিনি একটি জাহাজ হারান এবং অন্য একটি জাহাজ দেশে ফিরে যায়। প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ম্যাজিলান ফিলিপিন্সে পৌঁছেন। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে এক সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। পরে মাত্র সতেরজননাবিক এবং একটি জাহাজ নিয়ে এই মহা অভিযানটি সমাপ্ত করেন ক্যাপ্টেন সেবাস্তিয়ান ডেল ক্যানো।
সংস্কার শিক্ষার পুনর্জন্ম, যা রেনেসাস নামে পরিচিতÑতা ধর্মীয় আন্দোলনে এক বিরাট ভূমিকা রাখেÑ-একে আমরা সংস্কার হিসাবে আখ্যায়িত করি। সে সময় যারা দর্শন চর্চা করতেন তারা চার্চের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন এবং চার্চের প্রশাসন ও নেতৃত্ব কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ধর্মের ক্ষেত্রে চার্চের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন প্রচলিত রীতিবিরোধী অনেক শিষ্য। তারা বাইবেল শিক্ষার ওপর আরও আস্থাশীল হতে আহ্বান জানান এবং প্রার্থনা আরও সহজ করার কথা বলেন।
সত্যিকারভাবে সংস্কার শুরু ১৫১৭ সালে জার্মানিতে, যখন অগাস্টিনিয়ান সন্ন্যাসী মার্টিন লুথার ভিটেনবার্গের চার্চের দরজায় পাপের ক্ষমা বিক্রির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একটি প্রতিবাদপত্র পেরেক ঠুকে লটকিয়ে দেন। লুথার খুব শিগগিরই সমর্থন পেয়ে যান। কিন্তু পোপ দশম লিও ও রোমের মহান সম্রাট পঞ্চম চার্লস এই নতুন আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করলেও দ্রুত তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
সুইজারল্যান্ড, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, স্কটল্যান্ড ও আরও অনেক ছোট ছোট জার্মান রাজ্য খুব তাড়াতাড়ি এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করে, যাকে প্রােটেস্ট্যান্টিজম বলে অভিহিত করা হয়। কারণ এর অনুসারীরা রোমান চার্চের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। অষ্টম হেনরি তার স্ত্রী আরাগনের ক্যাথেরিনকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলে পোপ সপ্তম ক্লিমেন্ট বাদ সাধেন। ফলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে রোমান চার্চের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। রাজা অষ্টম হেনরি পুত্রসন্তান লাভের জন্য আবার বিয়ে করতে চান। ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ এই বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং তার পরপরই তা সংসদে অনুমোদিত হয়। ১৫৩৪ সালে সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রবিধান বলে ইংল্যান্ডের রাজা চার্চের প্রধান হিসাবে স্বীকৃত হন। তিনি প্রােটেস্ট্যান্ট ধর্ম গ্রহণ করেননি ঠিকই, কিন্তু তার প্রজারা পোপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে এই ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। হেনরি মঠের সম্পদ নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন, যা রাজ্যের সম্পদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায় আর এভাবেই চার্চের ক্ষমতা ধ্বংস করা হয়।
রোমান ক্যাথলিক চার্চ এই সংস্কারের জবাব দেয় তার নিজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে যার সূচনা ১৫৬০ সালে এবং চার্চ বেশ কিছু জরুরি ধর্মীয় সংস্কার সাধন করে।