ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের কোলাবাজারের মহিলারা নিজেরা পরিশ্রম করে স্বাবলম্বি হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন সে মার্কেট টি প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়ে পড়েছে। আগের মত ক্রেতারা দোকানে আসা-যাওয়া করে না। যখন কোলাবাজারে মহিলা মার্কেট বলে পরিচিত হল তখন ব্যাপক হারে ক্রেতারা কেনাবেচা করতো। সে সময়ে ৮ টি দোকান চালু করা হয় কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৪ টি দোকান চালু রয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলায় মহিলা মার্কেটি বেশ আলোচিত ও জমজমাট হয়েছিল।
মহিলা মার্কেটের চায়ের দোকানী ব্যবসায়ি কোহিনূর বেগম প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চা বিক্রিতে ব্যস্ত থাকতেন। সাথী কসমেটিক্সের দোকানী ব্যবসা করছেন। দোকান টি মোটামুটি চলছে। কাটা কাপড়ের দোকানী ব্যবসায়ি শাহানারা খাতুনের কাজের চাপ ও ক্রেতাদের ভীড়ের কারণে কথা বলার সময় যেন ছিলনা। তিনি নিজেই বিভিন্ন পোশাক তৈরির কাপড় কাটা ও সেলায়ের কাজ করতেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস তার সেই দোকান টি এখন বন্ধ হয়ে পড়েছে। দূর্গা রানীর তুলসি মালার দোকান, কেনা বেচা অনেকটা ভাল ছিল সেটিও বন্ধ হয়ে গেছে। ইশিতার মুদিখানা দোকানে সব সময় ভিড় লেগেই থাকতো। এ ছাড়া বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্যাদি ও পাওয়া যেত তার দোকানে। সেটি এখন আর খোলা পাওয়া যায় না। জহুরা খাতুন দোকানের কিছু আসবাবপত্র তৈরি করে বেশ মালামাল তুলে ছিল, সেটি ও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ৪ টি দোকান চালু করার কোন উপায় তাদের নেই।
ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ কোলাবাজার মহিলা মার্কেটের দোকানী ব্যবসায়িরা এলাকায় বেশ পরিচিতি লাভ করে। এলাকার ক্রেতাদের ও ভীড়ছিল তুলনামুলক। কালীগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে এক অজপাড়া গাঁয়ে গড়ে উঠেছে এই মহিলা মার্কেটটি। দোকানীরা জানান, ২০০৭ সালের গ্রাম্য হাট বাজার উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ৮ টি দোকান ঘর নির্মাণ করেন। এলাকার অসহায় মহিলাদের মাঝেই বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছিল। কালীগঞ্জের ২ নং জামাল ও ৩ নং কোলা ইউনিয়নে রয়েছে প্রায় ৪০ টি গ্রাম। মাঝে রয়েছে কোলা বাজার। এই বাজারে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন। এছাড়াও এই বাজারে ৫ টি ব্যাংক, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোস্ট অফিস,তহশীল অফিস, বিভিন্ন এনজিও অফিস, পুলিশ ফাঁড়ি, কৃষি অফিসসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্রামাঞ্চলের এই বাজারে শনি ও মঙ্গলবার হাটের দিন ছাড়াও সপ্তাহের অন্যান্য দিন গুলোতেও লোকজনের উপস্থিতি থাকে বেশ জমজমাট। এছাড়াও এ অঞ্চলের মহিলাদের জন্য নতুন মার্কেটটি সব সময় থাকে জমজমাট। দোকানীরা জানান, এ মার্কেটে ঘর নিতে তাদের কোন জমানত দিতে হয়নি। তাদের অধিকাংশেরই স্বামী সংসার নেই,এ কারণে নিজেরাই ব্যবসা করে জিবিকা নির্বাহ করে। এ মার্কেটে ব্যবসা করা মহিলারা বলেন, আমরা সমাজের এক অসহায় মানুষ তাই এ মার্কেটে দোকান পেয়ে স্বনির্ভর হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছি।
কালীগঞ্জের খালকুলা গ্রামের সাথী খাতুন জানান,তার বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের ১২ বছর পর স্বামীর অকাল মৃত্যু হয়। বাবা মায়ের অভাবের সংসারে তিনি যখন বড় বোঝা হয়ে দাড়ায়, ঠিক সে সময় কোন কিছু বুঝতে পাছিলেন না। এক পর্যায় জানতে পারেন কোলা বাজারে মহিলা মার্কেটে দোকান বরাদ্ধ চলছে, সাথি অনেককিছু চিন্তা ভাবনা করে মহিলা মার্কেটে একটি দোকান বরাদ্ধ নেয়। হাটি হাটি পা করতে সাথী ক্রমান্বয়ে স্বনির্ভর হয়। দোকানে তিনি প্রথম ২০ হাজার টাকার মালামাল তুলে বিক্রী শুরু করেন। এতে করে সাথির প্রতি দিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। সাথি বলেন জীবনে কষ্ট করলে প্রতিটি অসহায় মানুষ তার জীবনের সাফল্য বয়ে আনতে পারেন। বর্তমানে কোলাবাজারে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেয়েছে, যে কারণে তাদের মহিলা মার্কেটে আগের মত ক্রেতা আসে না মালামাল বিক্রি হয় না। যে কারণে ৪ টি দোকান বন্ধ হয়ে গেছে তারা দীর্ঘদিন দোকান খোলে না।
অপরদিকে শাহানারা খাতুনের বাড়ি উপজেলার জয়নগর গ্রামে। স্বামীর সংসার বিতাড়িত হবার পর বাবা মায়ের অভাবী সংসারে ফিরে এসে বেশ কিছুদিন অসহায়ের অবস্থায় থাকেন। পরবর্তীতে একটি একটি সেলাই মেশিন কিনে বাড়িতে বসেই পোশাক তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু যথেষ্ট পরিমান কাজ না থাকায় তার পক্ষে সংসারের অভাব লেগেই থাকতো। পরে মহিলা মার্কেটে দোকান বরাদ্ধ নিয়ে নিজেই কাজ শুরু করেন, শাহানারার কাজের মান ভাল হবার কারণে ক্রমান্বয়ে কাজের পরিমান বেশি হতে থাকে। তিনি দোকানে ৩০ হাজার টাকার মালামাল তুলে প্রায়দিনই ৩০০ থেকে-৫০০ টাকা আয় হত। যা দিয়ে তার সংসারে স্বাচ্ছন্দ ফিরিয়ে ছিলেন। এলাকার মানুষ বড় বড় কাপড়ের দোকান টেইলার্সে বেশি যায়। ফলে ক্রমান্বয়ে শাহারা খাতুনের দোকান টি বন্ধ করে বাড়ি চোলে গেছে।
চায়ের দোকানী কালীগঞ্জের খানজাপুর গ্রামের কোহিনুর খাতুন জানান, তার বিয়ে হয়েছিল ঝিনাইদহ মহেশপুর উপজেলার মিয়া সুন্দরপুর গ্রামে। যৌতুক লোভী স্বামীর কারণে তার সংসার ভেঙ্গে গেছে। তার নিজের কোন অর্থ ছিল না। স্থানীয় দুটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা লোন নিয়ে দোকানের কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতি সপ্তায় তাকে ৩৪০ টাকার কিস্তি দিতে হত। তার দোকানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা আয় হত, সে টাকা দিয়ে কিস্তি পরিশোধ করে সংসার খরচ করতে সমস্যা হত না। তবে আগে যে পরিমান বেচাকেনা হয় এখন সেটা হয় না সে জন্য দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। অনেক সময় ক্রেতা বিহীন বসে থাকতে হয়। অপরজন দূর্গা রানীর বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর গ্রামে। বাবা অত্যান্ত অসহায় গরীব। বাবার অভাবী সংসারে তিনি একমাত্র উপার্জনকারী ছিল। দোকানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হত এবং এ টাকা দিয়ে সংসারের ব্যায় করতাম। দোকানী ব্যবসায়িরা জানান, এ মার্কেটে ঘর বরাদ্ধ পেয়ে অসহায় এসব মহিলারা স্বনির্ভর হবার পথ খুজে পেয়েছিল। তবে ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক তাদের দোকান গুলোতে মালামাল তুলতে পারছিল। কিন্তু ৪ টি দোকান নিয়মিত খোলা হয় অপর ৪ টি দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সাথি ইসলাম,ইরিনা ইসলাম,দিপা অধিকারি ও কোহিনুর খাতুন নিয়মিত ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা অনেক টাই কম যে কারণে তাদের ব্যবসা করে তেমন টা লাভবান হচ্ছে না। এরা জানান, বর্তমানে দোকানের সামনে ও বাজারের পরিবেশ টা তেমন উন্নত না হবার কারণে ক্রেতারা আসতে চায় না। কোলাবাজারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা মহিলা মার্কেটে এখন কম আসে। বছর ১০ আগে মহিলা মার্কেটটি ছিল ব্যাপক জমজমাট। যে ৪ টি দোকান বন্ধ করে চোলে গেছে তারা আর্থিক সংকটের কারণে ও ক্রেতাদের কাছে বাকি পড়ে রয়েছে। অনেক চেষ্টা করে ও তারা সে বাকি টাকা আদায় করতে পারনি। ফলে তারা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। স্বাবলম্বির পথ ধোরে রেখেছে ৪ জন,তারা নিয়মিত তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।