ধৈর্যর বাঁধ ভেঙ্গে গেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের সামনের সারিতে থাকা দেশগুলোর। এদের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ ভানুয়াতু, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি এবং এশিয়ার ফিলিপিন্স, পাকিস্তান চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্ব নেতাদের উপস্থিতিতে তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরের অনুচ্চ দ্বীপপুঞ্জ ভানুয়াতু জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণ রোধ চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলায় বিশ্বের নজর ফেরানোর লড়াই জোরদার করেছে। গত শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভানুয়াতুর প্রেসিডেন্ট নিকেনাইক ভুরোবরাভু বলেছেন, “সময় শেষ, এখন পদক্ষেপ প্রয়োজন।” তার প্রস্তাবিত চুক্তির লক্ষ্য হচ্ছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমিত রাখতে কয়লা, তেল ও গ্যাসের উৎপাদন কমিয়ে আনা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেন প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছিল। “চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল প্রতিটি দেশ, সম্প্রদায় ও কর্মীর ন্যায্য রূপান্তর প্রক্রিয়া সচল করবে,” বলেছেন কার্বন-নেগেটিভ (নিঃসরণের তুলনায় বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নেওয়া) দেশ ভানুয়াতুর প্রেসিডেন্ট ভুরোবরাভু। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকারি প্যানেল (আইপিসিসি) ইতোমধ্যে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ যে পথে রয়েছে তাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা তো টপকাবেই, এ শতাব্দীর শেষনাগাদ তা ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষার অধিকার সংক্রান্ত মতামত দিতে ভানুয়াতু আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের কাছে অনুরোধও করেছে। “এই পদক্ষেপ জলবায়ু সংক্রান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার গতি বাড়ানোর জন্য সিলভার বুলেট হবে না; মানবজাতির জন্য একটি নিরাপদ গ্রহের লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার কেবল সহায়ক একটি উপকরণ হবে,” বলেছেন ভুরোবরাভু। পাকিস্তানের বিশাল অংশ সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে, নজিরবিহীর এই দুর্যোগ এরইমধ্যে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ৩ হাজার কোটি ডলার। বিশ্বনেতাদের কাছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ তার দেশকেই কেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মূল্য চুকাতে হচ্ছে, সে প্রশ্ন করেছেন। “বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবের এমন তীব্র ও বিধ্বংসী উদাহরণ আগে কখনোই দেখেনি পাকিস্তান। পাকিস্তানে জীবনযাত্রা চিরতরে বদলে গেছে। আমাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কেমন, তা না দেখেই প্রকৃতি তার রাগ পাকিস্তানের ওপর ঝাড়ছে,” সাধারণ পরিষদে শরিফ এমনটাই বলেছেন। গত শুক্রবার তরুণরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপের দাবিতে বিশ্বজুড়ে কর্মসূচিও পালন করেছে। নিউ জিল্যান্ড, জাপান থেকে শুরু করে জার্মানিতে বিক্ষোভ হয়েছে। ধনী দেশগুলো যেন দরিদ্র দেশগুলোকে বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ দেয় তার দাবি উঠেছে নিউ ইয়র্কের রাস্তায়। জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলন কপ২৭ এর ছয় সপ্তাহ আগে বিশ্বজুড়ে এই বিক্ষোভ হল। এবারের কপ সম্মেলনে বাড়িঘর, স্থাপনা ও জীবনযাপনে জলবায়ু সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো বাকি দেশগুলোর ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। “শতাব্দীর সর্ববৃহৎ চ্যালেঞ্জ, জলবায়ু পরিবর্তন নামক দৈত্যর বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণার জন্য বিশ্বের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি আমরা। এতগুলো বছর হয়ে গেল, আমাদের বিশ্ব এখনও জীবাশ্ব জ্বালানির নেশা কাটাতে পারল না,” মঙ্গলবার জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বলেন মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট ডেভিড কাবুয়া। ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে কম যারা দায়ী, তারাই বেশি ভুগছে। “ফিলিপিন্স যত কার্বন নিঃসরণ করে তার চেয়ে বেশি শুষে নেয়। তা সত্ত্বেও আমরা এখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে চতুর্থ স্থানে আছি,” বলেছেন তিনি। গত শুক্রবার জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বিশ্বকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলায় ব্যাপক অগ্রগতি দরকার হলেও, বিশ্ব তার ‘ধারেকাছেও যেতে পারেনি’। “এই সংকট সৃষ্টির জন্য যাদের দায় নেই, তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য চুকাতে হচ্ছে,” প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এমনটাই বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি ধনী দেশগুলোর প্রতি জীবাশ্ব জ্বালানি কোম্পানিগুলোর ওপর ব্যাপক করারোপ করতে এবং সেই অর্থ দিয়ে জলবায়ু সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে এবং খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে যারা ভুগছে তাদের সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনই সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে দিনকয়েক আগে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সতর্ক করে বলেছিলেন, “আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।” ফিজির প্রথানমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক বেইনিমারামা নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, যা করা দরকার বলে সবাই জানি তা করার সাহসের ঘাটতি নিয়ে জলবায়ু যুদ্ধে লড়া হচ্ছে। তিনি সংকটের সমাধানে পদক্ষেপের গতি বাড়াতে বিশ্বের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আসন্ন বছরগুলোতে দেশের জনগণ ও বিশ্বের জন্য জলবায়ু সংকট মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে চাইছে ফিজি। "জানতে চাইছি, আপনারা কি আমাদের সঙ্গে আছেন? যদি প্রমাণ করার পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে হ্যাঁ বলবেন না,” বলেন বেইনিমারামা।