প্রথমবারের মতো শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ ফুল চাষ করা হচ্ছে। ব্যতিক্রমী এ ফুল চাষে যেমন অনাবাদি জমি চাষ যোগ্য হচ্ছে, তেমনি এলাকার বেকার মানুষের বাড়তি আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গোলাপ চাষ শুরুর পর বেকার যুবকরা পেয়েছেন কর্মসংস্থানের পথ। আর পতিত জমি চাষের আওতায় আসায় জমির মালিকরাও আর্থিকভাবে হয়েছেন লাভবান।
জানা গেছে, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় শত শত একর জমি সেচ সংকট ও হাতির উপদ্রোপের কারণে অনাবাদি থাকে। সম্প্রতি ওইসব জমিতে হাতির উপদ্রোপ থেকে বাঁচতে কেউ কেউ কাটাযুক্ত লেবু বাগান আবার কেউ কেউ দেশি-বিদেশি নানা ফুল-ফলের বাগান করেছেন। তবে জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলার সন্ধ্যাকূড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী নামে এক ফুল ব্যবসায়ী এবার বাণিজ্যিকভাবে ব্যতিক্রমী নানা রঙ ও প্রজাতির গোলাপ চাষ শুরু করেছেন।
ফুল চাষি মোহাম্মদ আলী বলেন, ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া এলাকার সন্ধ্যাকুড়া গ্রামে অনাবাদি ১ একর ২৫ শতক জমিতে গড়ে তুলেছেন তার স্বপ্নের গোলাপ বাগান। গত ১৫ বছর যাবত তিনি ঢাকার শাহবাগ, উত্তরা, ধানমন্ডি এবং গুলশানে ফুলের ব্যবসা করতেন। একসময় চিন্তা করেন নিজ গ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলের পতিত জমিতে গোলাপ চাষ করবেন। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চুক্তি ভিত্তিতে সাড়ে তিন লাখ টাকায় আট বছরের জন্য জমি লিজ নেন। গোলাপ বাগানের নাম রাখেন জননী ফ্লাওয়ারস গার্ডেন। নিজের পুঁজি এবং বিভিন্ন এনজিও থেকে প্রায় ১৮ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে যশোর ও ভারতের চেন্নাই থেকে দুই দফায় চাইনিজ ও থাই জাতসহ ৫ রঙের ১৭ হাজার ৫ শ গোলাপের চারা সংগ্রহ করেন। জমিতে জৈব সার, টিএসপি ও ইউরিয়া ব্যবহারের পর ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে চারা রোপণ শুরু করেন। চারা রোপণের দুই মাস পর থেকে ফুল আসা শুরু করে। তবে বিক্রি উপযোগী ফুল পাওয়া যায় চার মাস পর থেকে। সাড়ে সাত মাস বয়সী এ বাগানে এখন শোভা পাচ্ছে সাদা, লাল, হলুদ, গোলাপি ও কমলা রঙের বাহারী গোলাপ।
মোহাম্মদ আলী বলেন, বাগান করার মাঝ পথে বর্ষা মওসুম শুরু হয়। এ সময় হঠাৎ পাহাড়ি ঢলে বাগান বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। যে কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হই। পরে আবার ধার দেনা করে বাগানটা দাড় করানোর চেষ্টা করি। বাগানটির বয়স এক বছর পূর্ণ হলে আশা করছি আরও ভালো কিছু হবে। মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, শীত মওসুম গোলাপের ভরা মওসুম। আর ওই সময়ে পাহাড়ি অঞ্চলে বন্যহাতির আনাগোনাও বেড়ে যায়। হাতির দল যেদিক দিয়ে যায়, সেখানকার সকল ধরণের ফসল পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে। তিনি বন্যহাতি প্রবণ এ এলাকায় হাতি যাতে ফুল-ফলের বাগান নষ্ট করতে না পারে,সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সহযোগিতা চেয়েছেন।
বাগান শ্রমিক ফজলুর রহমান ও কুসুম আলী বলেন, তারা বাগানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। প্রতিটি গাছের পরিচর্যা ছাড়াও বিক্রির জন্য ফুল কাটিং, পরিস্কার করা এবং পাইকারদের হাতে পোঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এজন্য তারা মাসিক ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা মজুরি পান। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে আরও বেশ কিছু শ্রমিক দৈনিক চুক্তি ভিত্তিতে শ্রম দেন। তারা মনে করেন এলাকায় গোলাপ বাগান হওয়ায় বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে স্থানীয় বেশ কয়েকজন যুবক।
স্থানীয় পাইকার আছর আলী এবং মোকছেদ বলেন, উৎপাদিত গোলাপ স্থানীয় বাজার ছাড়াও ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় বিক্রি হচ্ছে। দৈনিক গড়ে প্রায় ২ হাজার পিস ফুল সংগ্রহ করা হয়। যার ১শ পিসের ফুলের ঝুড়ি দুই থেকে চার হাজার টাকায় হাত বদল হয়।
জমি লিজদাতা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদ আলীর সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই গোলাপ বাগান তৈরি করতে আগ্রহী হচ্ছেন। তার আরও কিছু পতিত থাকা জমি ভাড়া নিয়ে স্থানীয় যুবকরা গোলাপ বাগান করতে চাচ্ছেন।
স্থানীয় দোকানদার রশীদ জামান ও গেদা মিয়া বলেন, এলাকায় ফুলের রানী গোলাপের দেখা পেতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসছেন। এ কারণে তাদের বেচাকেনাও বেড়েছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন দিলদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এক ইঞ্চি জমিও যেনো পতিত পড়ে না থাকে। আমরা সে নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এখানে স্থানীয় যুবক মোহাম্মদ আলী গোলাপ বাগান করেছেন। মাত্র সাড়ে সাত মাসে তিনি ওই বাগান থেকে প্রায় চার লাখ টাকা আয় করেছেন। আশা করছি তাকে দেখে স্থানীয় উদ্যোক্তারা ফুল চাষ করলে তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। সেসাথে পরিবেশ ও ফসলের বৈচিত্রও সমৃদ্ধ হবে।