বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাচীনতম জনপদের নাম কাপাসিয়া। এ দেশের প্রাচীন ভূখন্ডগুলোর অন্তর্ভুক্ত কাপাসিয়ার সমগ্র অঞ্চল। এ অঞ্চলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। মুসলিমপূর্ব যুগ হতে সমগ্র মুসলিম শাসন আমলে উত্তরে টোক থেকে শুরু করে পূর্বে কিশোরগঞ্জ ও দক্ষিণে সোনারগাঁও পর্যন্ত এলাকা জুড়ে উৎপাদিত হতো ইতিহাস বিখ্যাত কিংবদন্তির মসলিন কাপড়। সেই অতি সুক্ষ্ম মসলিন বস্ত্রের জন্য মিহি আঁশের কার্পাস তুলা উৎপাদিত হতো শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে। সংস্কৃত ও হিব্রু ভাষায় তুলার অপর নাম কার্পাস। পার্সী ভাষায় কারবস, বাংলা ও হিন্দী ভাষায় কাপাস। কাপাসের গাছকে বলা হয় কাপাসি। এই কার্পাস শব্দ হতে কাপাসিয়ার নামকরণ করা হয়েছে বলে অধিকাংশ গবেষকগণ মনে করেন। খ্রিষ্টপূর্ব যুগ হতে এ অঞ্চলে কার্পাস তুলার ব্যাপক চাষাবাদ ছিল। কাপাসিয়া ছিল মসলিন উৎপাদন ও বিক্রয়ের জন্য একটি বৃহৎবাণিজ্য কেন্দ্র। কার্পাস ও রেশমী বস্ত্র প্রাচীন বাংলার অর্থনীতিকে করেছিলো শক্তিশালী। কাপাসিয়ার ভূমি ও আবহাওয়া তুলা উৎপন্ন হওয়ার বেশ উপযোগী ছিল। পর্যাপ্ত পরিমানে কার্পাস তুলা উৎপন্ন হওয়ায় এই স্থানের নাম কাপাসিয়া হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। মসলিন কাপড় পৃথিবীর সর্বত্র সমাদৃত ছিল। সে মসলিনের জন্য বঙ্গদেশের সুলতানদের বেগমরা যেমন লালায়িত ছিলেন তেমনি দিল্লীর মুগল স¤্রাটদের বেগমরাও ব্যাকুল ছিলেন। এটা তাদের প্রিয় বস্ত্র ছিল। এ বস্ত্র ছিল সৌন্দর্য্যরে অহংকার।
খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক ভৌগোলিক দিউ গোরাস কাপাসিয়া অঞ্চলের সূতীবস্ত্র ও তার রংয়ের উপকরণ সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য লিখেছেন তাঁর রচিত গ্রন্থে। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে এ গৌরবময় মসলিন শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে সম্পূর্ন ধ্বংস করা হয়।
মসলিন কাপড় উৎপাদন ও বিক্রয়ের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল কাপাসিয়ার এই জনপদ। কাপাসিয়ায় উৎপাদিত কার্পাস তুলার অতি মিহিম কাপড় আরব ও ইউরোপে রপ্তানি হতো। কালের পরিক্রমায় কাপাসিয়া তার এই ঐতিহ্যটিকে হারিয়ে ফেলেছিল। দীর্ঘদিন পর হলেও কাপাসিয়া উপজেলার হারিয়ে যাওয়া সেই কার্পাসের ঐতিহ্যটিকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কাপাসিয়ার সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির ঐকান্তিক ইচ্ছে ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একেএম গোলাম মোর্শেদ খানের প্রচেষ্টায় কাপাসিয়া উপজেলায় কার্পাস তুলা চাষকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একেএম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার নামটি এসেছে মূলত কার্পাস নামক তুলা থেকে। হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারকল্পে মাননীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা প্রশাসন, তুলা উন্নয়ন বোর্ড ও চাষিদের সমন্বিত উদ্যোগে কার্পাস তুলা চাষে উপজেলায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে কাপাসিয়ার চারটি ইউনিয়নে ১১০ বিঘা জমিতে কার্পাস তুলা চাষ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রামে গ্রামে চাষ করা হবে। এক সময়ের অনাবাদি ও পতিত জমিতে তুলা চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা।
প্রাচীন রাজা-বাদশাদের আমলের বিখ্যাত কাপড় মসলিন তৈরির মূল উপাদান তুলার উৎপাদনটা শুরু হয়েছিল মূলত কাপাসিয়ায়। তবে সময়ের পরিক্রমায় কাপাসিয়া থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তুলার চাষ। ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় তৈরির মূল উপাদান ছিল কার্পাস তুলা। শুরুতে এ অঞ্চলে তুলার চাষ কিছুটা ধীরে হলেও বর্তমানে তুলা চাষের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে।
রায়েদ ইউনিয়নের আমরাইদ এলাকার তুলাচাষী মোঃ মফিজ মোল্লাহ বলেন, প্রমবারের মতো দুই বিঘা জমিতে তুলার চাষ করেছি। তুলা চাষে খরচ সর্ম্পকে তিনি জানান, ৩ মাসের ব্যবধানে ১ বিঘা জমিতে তুলা চাষের জন্য নূন্যতম ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তবে তুলা চাষের জন্য সার, বীজ, কীটনাশকসহ যাবতীয় খরচ কৃষি অফিস বহন করে। আমাদের শুধুমাত্র পরিশ্রমটুকুই যায়। এজন্যই মূলত তুলা চাষে লাভের পরিমাণটা অনেক বেশি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে ক্ষয়-ক্ষতির সম্ভাবনা একবারেই নেই। এ ছাড়া ধান এবং কলা চাষের চেয়ে তুলা চাষে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি।