নেত্রকোনার কলমাকান্দায় ঘুষ দিয়ে সনদ কিনে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন এক ব্যক্তি। সেই সনদে আবার নিয়মিত সম্মানী ভাতাও উত্তোলন করছেন তিনি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পায় স্থানীয় প্রশাসন। তদন্তে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক কাছে আবেদন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও)। অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম মো. আমজাদ হোসেন। তিনি উপজেলার খারনৈ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
কলমাকান্দার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মো. আবুল হাসেম সোমবার অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন। এরআগে গত ৩১ আগস্ট কলমাকান্দা উপজেলার সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে লিখিত এ অভিযোগটি দেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইউএনও কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আমজাদ হোসেন কোন মুক্তিযোদ্ধা নন। তবু ভূয়া সনদ বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা উত্তোলন করছেন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের এমন লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্তে নামে প্রশাসন। সেই লক্ষে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমকে সরেজমিন ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেন ইউএনও। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কথা বলে ও বিভিন্নভাবে কাগজপত্র যাচাই বাচাই শেষে মো. আমজাদ হোসেন একজন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে প্রমাণ পান তিনি। ৪ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিবেদন আকারে এই বিষয়টি ইউএনওকে জানান। পরে ২ অক্টোবর ইউএনও মো. আবুল হাসেম তদন্ত প্রতিবেদনের সাথে একমত পোষণ করে আমজাদ হোসেনকে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আমজাদ হোসেন কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। তিনি ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কলমাকান্দা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নকল নবীশের কাজ করতেন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মো. আমজাদ হোসেন কোনো দিন কারো কাছে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয়ও দেননি। সম্প্রতি মো. আমজাদ হোসেন কলমাকান্দার সোনালী ব্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা ও ঈদ বোনাস উত্তোলন করায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা হতবাক হয়ে পড়েন। মো. আমাজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেনাবাহিনীর সদ্য হিসেবে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতা তুলছেন। অথচ তিনি কোনদিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করেননি। এ বিষয়টি জেনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা আরও অবাক হন।
কলমাকান্দা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমজাদ হোসেন মুক্তিযোদ্ধা রুপে আভির্ভূত হয়েছেন। সম্মানী ভাতা ও ঈদ বোনাস তুলছেন এতে কলমাকান্দার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার আভির্ভাব ঘটলে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম আরও বলেন, মো. আমজাদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেনাবাহিনীর লেন্স নায়েক ছিলেন এমন ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। অথচ তিনি কখনই সেনাবাহিনীতে চাকুরি করেননি। এমনকি কোন সরকারি চাকুরিও করেননি কোনদিন। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন তালিকাতেই তাঁর নাম নেই। অথচ সম্প্রতি তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করে সম্মানী ভাতা উত্তোলন করছেন।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল জব্বার বলেন, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তথ্য যাচাই-বাচাই নিজ উপজেলা থেকে করা হয়। অথচ আমজাদ হোসেন তারঁ সবকিছু মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করেছেন। বিষয়টি আমাদের নজরে এলে মো. আমজাদ হোসেনের কাগজপত্র যাচাই বাচাই করলে ভুয়া প্রমাণিত হয়। ওইসব কাগজপত্রে তাঁর নাম ছাড়া পিতা-মাতা, ঠিকানা কোন কিছুই নেই। এতে আমাদের ধারণা-মুক্তিযুদ্ধের সময় মো. আমজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি সোনবাহিনীর কোন লেন্স নায়েক ছিলেন। ওই নাম ধারণ করে প্রতারণার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন তিনি। তাই তদন্ত করে এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রতারক আমজাদ হোসেনকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন সেনাবাহিনীতে কোনোদিন চাকুরি করেননি বলে স্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় স্থানীয় মহাদেও এলাকার ক্যাম্পে যোগ দেন। শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে ভারতে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়নি। ক্যাম্প ইনচার্জের তত্তাবধানেই মহাদেও ক্যাম্পেই অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেই। পরে যুদ্ধও করেছি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এ বিষয়েটি অস্বীকার করতে পারবেন না। পরে ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার মুসলিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে গত জুনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মন্ত্রণালয়ে নাম অন্তর্ভুক্তি করিয়েছি। এজন্য তাকে কিছু খরচ দিতে হয়েছে। তবে ওই ব্যক্তি ভুলে আমাকে সেনাবাহিনীর তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভক্তি করিয়েছেন। এটি সর্ম্পূণ ভুল। কারণ সেনাবাহিনীতে আমি কোনদিন চাকুরি করিনি। এই ভুলটা ঠিক করে দেওয়ার জন্য তাকে চাপ দিচ্ছি। এ পর্যন্ত তিন চার মাসের সম্মানি ও ঈদ বোনাস উত্তোলন করেছেন তিনি স্বীকার করেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগটি করে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযুক্ত মো. আমজাদ হোসেন টাকা দিয়ে ভুয়া সনদ বানিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে ইউএনও বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মো. আবুল হাসেম সাংবাদিকদের জানান, তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি।