নরসিংদীর বেলাবতে অতি মুনাফাখোর সুদি আসাদুজ্জামান আসাদের খপ্পরে পড়ে উপজেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক ব্যবসায়ী সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। সুদারু আসাদুজ্জামান উপজেলার মাটিয়াল পাড়া (বাগান বাড়ী) এলাকার আবদুর রাজ্জাক ওরফে রেজু মুন্সির ছেলে। আসাদ দীর্ঘদিন যাবৎ পোল্ট্রি ব্যবসার নাম করে স্থাণীয় ব্যবসায়ীদের প্রলোভন দেখিয়ে সুদের ব্যবসা চালিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সর্বশান্ত করেছে। তার পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে ব্যবসায়ীরা সহায় সম্বল ও ভিটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধ্যানকালে নরসিংদীর শিমুলতলী উপজেলার চন্দনপুর বটেশ্বরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হয়। তারা জানান নরসিংদী জেলার শিমুলতলী উপজেলাধীন মাটিয়াল পাড়া (বাগান বাড়ী) এলাকার আবদুর রাজ্জাক ওরফে রেজু মুন্সির ছেলে আসাদুজ্জামান একজন সুদারু। সে মেসার্স চিশতী পোল্ট্রি এ- ফিসফিড ব্যবসার আড়ালে সুধের ব্যবসা করে আসছে দীর্ঘদিন। এলাকায় সে একজন সুদের ব্যবসায়ী ও প্রতারক হিসেবে পরিচিত। সে এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তার নিয়োগকৃত দালাল (প্রতারক) চক্রের মাধ্যমে স্বল্প সুধে টাকা নিয়ে ব্যবসা করে লাভবান হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার নিকট থেকে টাকা নিতে উৎসাহিত করে। পরে টাকা নেওয়ার সময় কৌশলে তাদের নিকট থেকে জামানতের নামে অলিখিত ব্যাংক চেক ও ননজুডিসিয়্যাল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখেন। কিছু দিন পর প্রকাশ পায় আসল রুপ। সুদি আসাদ তার প্রয়োজনে স্বাক্ষর করা অলিখিত ষ্ট্যাম্পে ইচ্ছেমত টাকার অঙ্ক বসিয়ে ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য করেন। দাবীকৃত টাকা প্রদান করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে স্থাণীয় বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শণসহ ব্যবসায়ীদের নামে অর্থ আত্মসাধ ও জালিয়াতির মামলা করে দেন। আর এভাবেই একের পর এক ব্যবসায়ীর নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসাদ অল্প সময়ের মধ্যে টাকার পাহাড় গড়ে তোলে বনে যান কোটি কোটি টাকা ও সম্পদের মালিক।
ভূক্তভোগী সুজন খন্দকার বলেন, আমি চন্দনপুর গ্রামে মৃত খন্দকার গোলাম মোস্তফার ছেলে। 'আমি একজন ব্যবসায়ী। আমার ব্যবসায়ীক প্রয়োজনে আসাদের কাছ থেকে দুটি অলিখিত চেক ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করে মাসিক ৫০ হাজার টাকা সুদে ১০ লাখ টাকা আনি। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে আমার নিকট মোটা অংকের টাকা দাবি করে। পরে তার প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ৫ মাসে সুদ সমেত ১৭ লক্ষ টাকা দিয়ে বিষয়টি আপস মিমাংসা করে সমুদয় টাকা তার ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করি যার সকল প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। তার সকল টাকা দেওয়ার পরেও সে আমার স্ট্যাম্প ও চেক ফেরত না দিয়ে বিভিন্ন টালবাহানায় সময় পার করে। পরবর্তীতে সে আমার কাছে পুনরায় ২০ লাখ টাকা দাবি করে। আমি দাবীকৃত সেই টাকা দিতে অস্বীকার করলে সে তার সুদি ব্যবসায়ীক পার্টনার মাদক ব্যবসায়ী হারুনের যোগ সাজশে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা দাবি করে গচ্ছিত একটি চেক ব্যাংক ফেরত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আদালত থেকে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা করিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করায়। একদিন কারাবাসের পর ২৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা আদালতে জামানত হিসেবে জমা দিয়ে জামিনে মুক্ত হই। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আসাদের নিকট জমাকৃত অপর চেকটিতে ৩৭ লাখ ৪০ টাকার অঙ্ক বসিয়ে তাইজুল ইসলাম নামে তার অপর সহযোগীকে বাদী করে উকিল নোটিশ পাঠায়। আমি তার বিরুদ্ধে আদালতে একটি জালিয়াতি মামলা দায়ের করেছি। এই সুদারু আসাদ এমনি ভাবে প্রতারণা করে আমার মতো বহু ব্যবসায়ীকে পথে বসিয়ে দিয়েছে।
একই এলাকার সুমন খন্দকার বলেন, আমি আসাদের নিকট থেকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা সুদে এনে সুদাসলে ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পরও সে এখনও আমার জমাকৃত চেক ও স্ট্যাম্প ফেরত দেয়নি। সে বর্তমানে আরো টাকা দাবি করে আমাকে হয়রানি করছে।
বটেশ্বর গ্রামের ব্যবসায়ী খলিলুল্লাহ তপন বলেন, আমার দোকান থেকে পোল্ট্রি ফিড নেওয়ার সুবাধে আসাদের যাতায়াত ছিল। সুযোগ বুঝে আসাদ আমার দোকানের ড্রয়ার থেকে আমার স্বাক্ষর করা একটি চেক চুরি করে নিয়ে যায়। পরে সেই চেকে ২৬ লাখ টাকা লিখে আমার বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। পরিশেষে এলাকাবাসীর মধ্যস্থতায় ১৫ লাখ টাকা দিয়ে তার সাথে আপস মীমাংসা করা হয়। আসাদ এলাকায় সুদারু আসাদ নামে পরিচিত। আর এ ভাবেই সে বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রতারণা করে বহু মানুষকে পথে বসিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছে। তার মামলার ফাঁদে পড়ে অনেক ব্যবসায়ী বর্তমানে জেল হাজতে রয়েছে। আবার অনেকে পালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
আনোযার হোসেন সবুজ বলেন, আমার পিতার মৃত্যুর পর আসাদ পিতার ঋণ বাবদ আমার কাছে ১ লাখ টাকা দাবি করে। আমি তার কাছে সেই ঋণ গ্রহণের প্রমান চাইলে সে কোন ধরনের প্রমান দিতে পারেনি। পরে একদিন বেলাব বাজার থেকে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক আমাকে অপহরণ করে তার বানানো টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে অলিখিত খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলে। আমি তাতে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এই নির্যাতনের কারণে আমি ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম।
কাউছার আহমেদ চপল বলেন, আমি আসাদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা সূদে নিয়ে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেছি। তার পরও আসাদের নিকট থেকে মুক্ত হতে পারিনি। সে আরো টাকার জন্য আমাকে প্রতিনিয়ত চাপ প্রয়োগ করে আসছে। এমনকি টাকা পরিশোধ না করলে আমার নামে আদালতে মামলা দেওয়ার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছে।
মো. ওমর ফারুক বলেন, আমি গত ৩ মাস আগে আসাদের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা সুদে এনে ছিলাম। প্রতি মাসে তাকে ১০ হাজার টাকা করে মোট ৩০ হাজার টাকা সুদ পরিশোধ করেছি। সে বর্তমানে আমার নিকট ১০ লাখ টাকা দাবি করছে। ওই টাকা না দিলে আমার নামে আদালতে মামলার হুমকি দিচ্ছে।
বাজনাব ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য করিম খন্দকার বলেন, সুদি আসাদের পাতানো ফাঁদে পড়ে বহু ব্যবসায়ী ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে এলাকাবাসী অসহায়। তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষতো দূরের কথা প্রতিষ্ঠিত কোন ব্যক্তি ব্যবসায়ীরাই মুখ খুলতে সাহস পায় না। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে আসাদ তাকে তার লালিত বাহিনী ও পুলিশ দিয়ে বিভিন্ন ভাবে হয়রানী করে থাকেন।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত আসাদ সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সুজনের সাথে আমার এলপিজি গ্যাসের পার্টনারে ব্যবসা ছিল। সে ব্যবসার টাকা না দেয়ায় আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি।