প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাদের সমাধিতে রোববার সন্ধ্যায় জ¦লে উঠবে কয়েক লাখ দীপ। শতবছরের ঐতিহ্যের স্মারক উপ-মহাদেশের সবচেয়ে বড় দীপাবলি উৎসব বরিশাল নগরীর কাউনিয়া মহাশশ্মানে অনুষ্ঠিত হবে। এ উৎসবকে ঘিরে ৫ একর ৪১ শতক আয়তনের মহাশ্মশান আজ আলোকিত হয়ে উঠবে।
প্রতি বছর ভূতচতুদর্শী পুণ্য তিথিতে এ উৎসব হয়ে থাকে। একই সাথে পালিত হয় কালিপূজা। প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশে তাদের সমাধিতে দীপ জ¦ালিয়ে দেয়ার এই প্রথা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে এখানে দীপাবলি উৎসব নামে পালিত হয়ে আসছে। যে কারণে কাউনিয়া মহাশ্মশানের এ দীপাবলি উৎসবের প্রথা শতবছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর এইদিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মহাশ্মশানে একত্র হয়ে প্রয়াত ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ করেন। সমাধির ওপর মোমবাতি জ¦ালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন। তাদের স্বর্গীয় আত্মার শান্তি কামনায় অনুষ্ঠিত হয় প্রার্থনা। পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির ছবি ফুল ও চন্দন দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় সমাধির ওপর। প্রিয়জনের উদ্দেশ্যে খাবার-দাবারও দেয়া হয়ে থাকে। সেইসাথে ধূপকাঠি জ¦ালিয়ে দেয়া হয়। কেউ কেউ ধর্মীয় গান ও খোল বাদ্য সহকারে কীর্তণ করেন প্রিয়জনের আত্মার সন্তুষ্টির জন্য।
দীপাবলি উৎসবকে ঘিরে মহাশ্মশান রক্ষা সমিতি দুইদিনব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রতিবছর শশ্মান দীপাবলি উৎসবে, সমাধিতে দীপ জ¦ালানো পর আলোর রশ্নিতে ভরে ওঠে মহাশ্মশান। এ উৎসব দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে বহু পর্যটক আসেন বরিশালে। তাদের কেউ কেউ আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের স্মৃতির উদ্দেশে দীপ প্রজ¦লন করেন।
এ উৎসবকে ঘিরে অনেকটাই বাণিজ্য মুখর হয়ে পরেছে বরিশাল। দেশ-বিদেশের মানুষ আসতে শুরু করায় ইতোমধ্যে আবাসিক হোটলগুলোর রুম বুকিং হয়ে গেছে। শ্মশান ও এর আশপাশের এলাকায় বাড়ছে মানুষের পদচারণা।
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা জানিয়েছেন, প্রতিবছর মহাশ্মশানে দীপাবলিতে লাখো লোকের সমাগম ঘটে। গত দুইদিন পূর্বে সমাধি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ শেষ করা হয়েছে। এর আগে সমাধিগুলোকে রং, মাটি দেয়া ও ইট-পাথরের খুঁটি-নাটির মেরামতের কাজ করা হয়। এসব কাজে প্রায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করেছেন। পাশাপাশি শ্মশান এলাকাজুড়ে আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
দীপাবলির পরদিনই কালিপূজা ॥ বরিশাল মহাশ্মশানের রক্ষা সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানিয়েছেন, রোববার সন্ধ্যা থেকে রাত ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ভূত চতুদর্শী পুণ্য তিথিতে দুইদিনব্যাপী উপ-মহাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহ্যবাহী দীপাবলি উৎসব এবং সোমবার রাত ১২টা ১মিনিটে শ্রীশ্রী কালীপূজা কাউনিয়া এলাকায় বরিশাল মহাশ্মশানে ও নতুন বাজার এলাকায় অমৃতাঙ্গণের (আদি শ্মশানে) অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে দীপাবলি উৎসবের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ। নিরাপত্তার দায়িত্বে পোশাকধারী র্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উৎসব এলাকায় মোতায়েন করা হবে। এ ছাড়া শ্মশানে আগতদের সেবা দিতে নিয়োজিত থাকবেন প্রায় দুই শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। মহাশ্মশান রক্ষা সমিতির পরিচালনায় সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় শ্মশানের যাবতীয় উন্নয়ন, কার্যক্রম সৌন্দর্যবর্ধন ও ঐতিহ্যবাহী শ্মশান দীপাবলি উৎসবের সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
সূত্রমতে, এখানে পাকা সমাধি রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। এরমধ্যে প্রায় সহ¯্রাধীক সমাধি রয়েছে যাদের কোনো স্বজন নেই। এ ধরনের শ্মশানকে নির্দিষ্ট রং দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমাধিতে হয়তো কোনোদিন কেউ ফুল দেবে না। তবুও শ্মশান দীপাবলি উৎসবে দীপ জে¦লে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্মশান রক্ষা সমিতির পক্ষ থেকে। মানুষ মরে গেলে স্মৃতি ধরে রাখার এ চেষ্টার মধ্যদিয়েই রয়েছে পূর্বসূরীর প্রতি উত্তর প্রজন্মের বিন¤্র শ্রদ্ধা।
শ্মশান রক্ষা সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, মৃত্যুর ৮০ বছর পর গত দশবছর আগে ভারতের কেওড়াতলা মহাশ্মশান থেকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের চিতাভস্ম এনে এ মহামশ্মশানে স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও এ মহাশ্মশানে রয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্র নাথ ঘোষ, মনোরমা বসু মাসিমা, রাজনীতিবিদ শরৎচন্দ্র গুহ, শিক্ষাবিদ কালি চন্দ্র ঘোষ, ভাষা সৈনিক রানী ভট্টাচার্য্য, জঙ্গীদের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত জজ জগন্নাথ পাঁড়ে, চারুশিল্পী বলহরি সাহা, শ্যামপুরের জমিদার কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরী নাটু বাবু, কবি রবীন সমদ্দার, সাংবাদিক আইনজীবী মিহির লাল দত্ত, রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশের বাবা সত্যানন্দা দাশ ও পিতামহ সর্বানন্দা দাশসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সমাধি।