সাদা সোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ীর ব্যাপক দরপতনে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে চিংড়ী চাষীরা। চিংড়ী চাষ মৌসুমের শুরুতে দাম মোটামুটি স্বাভাবিক থাকায় চাষীদের মুখে হাসি ছিল। কিন্তু মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতিনিয়ত দরপতনে সে হাসি ম্লান হয়ে গেছে। আর চিংড়ি শিল্পে ধস লেগেছে। খুলনার কয়রা-পাইকগাছা উপজেলায় অধিকাংশ মানুষ চিংড়ী শিল্পের উপর কোন না কোনভাবে নির্ভরশীল। পাইকগাছায় ১৭ হাজার ৭৫ হেক্টর ও কয়রা উপজেলায় ৬ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের চিংড়ি দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে থাকে। চিংড়ী চাষ অধ্যুষিত এ অঞ্চলে ৮০ এর দশক থেকে চিংড়ি চাষ শুরু হয়। খুলনা জেলার বৃহৎ একটি অংশজুড়ে চাষ হয় বাগদা চিংড়ি। খুলনা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, জেলায় বাগদা চিংড়ির ঘের রয়েছে ২৩ হাজার ৪৪০টি। ডুমুরিয়ায় ৭ হাজার ৮২১টি, কয়রা ৭ হাজার ২০০টি, পাইকগাছায় ৩ হাজার ৯৪০টি, দাকোপে ২ হাজার ৫১৬টি, বটিয়াঘাটায় ৮১১টি, রূপসায় ১ হাজার ১৫১টি ও তেরখাদায় ১টি ঘের রয়েছে। সোনালী আঁশ পাট শিল্প ধংসের পর এবার রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত চিংড়ি শিল্পও ধীরে ধীরে রুগ্নাবস্থার দিকে যাচ্ছে। চিংড়ি রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য মাত্রা ৩শ’ মিলিয়ন পাউন্ড বা প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও তার অর্ধেকও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং প্রতি বছর রপ্তানি আয় তিন থেকে চারশ’ কোটি টাকা কমছে। ২০১১-১২ সালে চিংড়ি রপ্তানি করে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৫৮০ মিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা আয় করেছিল। সে আয় কমতে কমতে গত ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে আয় হয়েছে ৪ হাজার ২১১ কোটি টাকা। যা প্রায় চারশ’ কোটি টাকার মতো কম। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ২৯ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা দেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)। এই আয় তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। অবশ্য চিংড়ির বৈশ্বিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ খুবই নগণ্য। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২১ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৮০৬ কোটি টাকার হিমায়িত চিংড়ি। এই শতাব্দীতে দেশ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। তারপর টানা সাত বছর পণ্যটির রপ্তানি কমেছে। সর্বশেষ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৩ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে, যা দেশি মুদ্রায় ২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এই আয় তার আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী চিংড়ির বাজার ছিল ৩ হাজার ১৬০ কোটি ডলারের, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৭ সালে এই বাজার বেড়ে ৫ হাজার ৪৬০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়া হলে এ খ্যাতটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে এর সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। পাইকগাছা-কয়রাসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সকল ব্যবসা বাণিজ্য চিংড়ীর উপর নির্ভরশীল। চিংড়ি চাষিরা এফএনএসকে জানান, একদিকে পোনা সংকট, দাম বেশি ও ভাইরাস জনিত মড়ক, জমির হারি বেশি ও দিনমজুরের ব্যাপক দাম। এরপর বাগদা চিংড়ির দাম অনেক কম। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে হাজার টাকার বাগদা ৬'শ টাকা, ৭'শ টাকার বাগদা সাড়ে ৪’শ টাকা। ফড়িয়া বা ব্যাপারিরা প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছে। পাইকগাছা চিংড়ী চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম কিবরিয় রিপন এফএনএসকে বলেন, এভাবে চিংড়ীর দরপতন হলে শুধু স্থানীয় নয় রাষ্ট্রও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমতাবস্থায় সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন চিংড়িচাষে সংশ্লিষ্টরা।