প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছায় লোনা পানির রোদে পোড়া মানুষের কাছে যেন নিত্যসঙ্গী হয়েছে। এর কারণ একের পর এক সিডর, আইলা, মহসেন, ফণি, নার্গিস, তিতলি, বুলবুল, আম্ফান, ইয়াস ও সর্বশেষ সিত্রাং নামক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে এ জনপদে। বার বার গুড়িয়ে দিয়েছে কোটি মানুষের একেকটি সোনালী সকালের স্বপ্নের প্রত্যাশা। সর্বশেষ খুলনায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ১৬৫০টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া ও অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে ১৮ হাজার ৪৮৩ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর সর্বোচ্চ জেলার পাইকগাছায় ১১২টি ঘেরের ৬.১ মেট্রিকটন মাছের ক্ষতি হয়েছে। তবে সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সুন্দরবন উপকূলীয় খুলনা অঞ্চলের পাইকগাছায় কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও বৃষ্টির প্রভাবে জেলার সর্বোচ্চ মাছের ঘের, কাঁচা ঘর-বাড়ি ও কৃষি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় ১১২টি মৎস্য ঘের, ২০৭টি কাঁচা ঘর ও ১৮৭ হেক্টর জমির কৃষি ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হচ্ছে। তবে উপজেলায় এবারই প্রথম কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুরক্ষিত ছিল ওয়াপদার বেড়িবাঁধগুলো। খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ এফএনএসকে জানান, ‘ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনায় মোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২২৯ মিলিমিটার। এর মধ্যে রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১২ মিলিমিটার এবং সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ২১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। উপজেলা কৃষি অফিসার জাহাঙ্গীর আলম এফএনএসকে জানান, সিত্রাংয়ে উপজেলায় সর্বোমোট প্রায় ১৮৭ হেক্টর জমির কৃষি ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। যার বেশির ভাগই আমন ফসল বলেও জানান তিনি। পাইকগাছা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. টিপু সুলতান এফএনএসকে জানান, সিত্রাংয়ে উপজেলার অন্তত ৮৩ জন চাষির ১১২টি মৎস্য ঘেরের প্রায় ৬.১ মেট্রিকটন মাছ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে উপজেলায় সর্বোচ্চ গড়-ইখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন মৎস্য ঘের তুলনামুলক বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা। মূলত রোববার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অতিবৃষ্টি এবং পানি সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়। এ ছাড়া গড়-ইখালীর নদী তীরবর্তী মাছের ঘেরগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলেও দাবি তার। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস এফএনএসকে জানান, দুর্যোগে আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ও কার্যত এর প্রভাব প্রতিফলিত না হওয়ায় সর্বসাধারণ দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়নি। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার পাল এফএনএসকে জানান, খুলনা জেলায় শুধুমাত্র পাইকগাছা উপজেলায় মৎস্য ঘেরের বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। সেখানকার ৮৩ জন মৎস্যচাষির ১১২টি ঘেরের ৬.১ মেট্রিকটন মাছের ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম এফএনএসকে বলেন, সিত্রাংয়ে আগাম সতর্কবার্তায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে বেশ আগেই সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া দুর্যোগের প্রভাবও কম ছিল তাই জান-মালের বিশেষ ক্ষতি হয়নি। এ ছাড়া এবারই প্রথম কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপজেলার বেড়িবাঁধের কোথাও ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটেনি। অতি বৃষ্টিতে কিছু এলাকার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপণ্ডপরিচালক (শস্য) মো. মোছাদ্দেক হোসেন এফএনএসকে জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া ও অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় জেলায় সর্বোমোট ১৮ হাজার ৪৮৩ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৭ হাজার ৯৪২ হেক্টর আমন ধানের ক্ষেত ও ২৯৩ হেক্টর সবজির ক্ষেত, ৩ হেক্টর সরিষা, ৪ হেক্টর মাসকলাই, ৬ হেক্টর মরিচ, ৯৫ হেক্টর পেঁপে, ১৩৪ হেক্টর কলা, ৫ হেক্টর পান ও এক হেক্টর ধনিয়ার ক্ষেত আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পানি সরে গেলে ক্ষতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার এফএনএসকে বলেন, সর্বশেষ সিত্রাংয়ের প্রভাবে খুলনায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ অবস্থান নিয়েছিল। তবে পূর্বের তুলনায় দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে কিছু ঘর, ফসলী জমি ও পাইকগাছায় সর্বোচ্চ মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।