রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের অনিয়ম আর সেচ্ছাচারিতা যেন কমছেই না। ক্ষমতার অপব্যাবহার দেখিয়ে তিনি চলছেন আপন গতিতে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের অনিয়মের খবর এফএনএস২৪, দৈনিক পরিবেশসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রতিবেদন বের হওয়ার পরে পরপর দুইবার তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারণে সেই তদন্ত ধামাচাপা পড়ে গেছে।এনিয়ে এলাকায় সাধারন জন-মনে চাপা ক্ষোপের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার সচেতন মহল মানব শেখরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্মে ফাঁকির অভিযোগ এনে অপসারণের দাবিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।
উল্লেখ্য,স্কুলের হাজিরা রেজিষ্টারে প্রধান শিক্ষক শেখরের নিয়মিত উপস্থিতি থাকলেও বেশিরভাগ দিনই স্কুলে অনুপস্থিতি থাকেন। শিক্ষকরা সপ্তাহে দুই - একদিন বিদ্যালয়ে এসে পুরো সপ্তাহের স্বাক্ষর করে যান। প্রধান শিক্ষকের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন দায়িত্ব পালনের সুযোগে অন্যান্য শিক্ষকগণ পাঠদান এবং স্কুলে আসা-যাওয়া করছেন খেয়াল খুশিমত। এ কারণে বিদ্যালয়টিতে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি শূন্যের দিকে যাচ্ছে।
সরকারি নির্দেশনায় প্রতিদিন পাঠদানের আগে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ, শপথ ও জাতীয় সংগীত বাধ্যতামূলক হলেও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সংগীত ও সমাবেশ হচ্ছে না। ২৩ অক্টোবর ২২ তারিখ সকাল ৯ টায় সরেজমিনে রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে গেলে দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ কেউ খেলাধুলা করছে। প্রতিনিধির উপস্থিতি টের পেয়ে প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের ফোন দিয়ে স্কুলে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন শিক্ষিক কণিকা রানি। তড়িঘড়ি করে মাত্র দশ থেকে পনের জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাই ছাত্রছাত্রী সমাবেশ (পিটি ক্লাস) শুরু করেন দেন। অথচ সেখানে সকল শিক্ষকের উপস্থিত থাকার কথা ছিল।
রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কণিকা রানিকে অন্যান্য শিক্ষকদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে আসেন, আবার কেউ কেউ রংপুর থেকে আসেন। তাই একটু লেট হয়।
৯.২৮ মিনিটে বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষক সুচিত্রা রানী। প্রতিবেদকদের দেখে হাজিরা রেজিষ্টারে আগমনের সময় লেখেন ৯.০০ টা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি যখনই আসি আর যাই না কেন আগমনের সময় ৯.০০ টা আর প্রস্থানের সময় ৩.১৫ লিখি।
রংপুর থেকে আসেন শ্যামলী রানী। উপস্থিতির রেজিষ্টার মোতাবেক জানা যায়, ১১ থেকে ১৩ অক্টোবর ও পরের দুই দিন শুক্র শনিবার মিলে মোট ৫ দিনের ছুটিতে ছিলেন। এরপর ১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর ক্লাস করেন। আবার ১৯ ও ২০ অক্টোবর স্কুলে আসেননি। সেই সাথে আবার শুক্র ও শনিবার মিলে মোট ৪ দিন ছুটিতে ছিলেন। ২৩ তারিখে বিদ্যালয়ে আসেন শ্যামলী। কিন্তু ২১ ও ২২ তারিখের উপস্থিতি ঘরে সিএল লেখা ছিলনা। প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ওই ২ দিনের ফাঁকা ঘরে আগমন ও প্রস্থানের সময় লিখতে না পেরে ক্ষেপে যান শ্যামলী রানী।
প্রতিবেদকের সামনেই খসখস করে আগমন ও প্রস্থানের মোট ৯ দিনের সময় ও স্বাক্ষর লিখলেন আরেক শিক্ষিকা কণিকা রানী। সব দিনই আগমন ৯.০০ টায় ও প্রস্থান ৩.১৫ মিনিটে লিখলে প্রতিবেদক তার কাছে জানতে চায়, আপনি এক দিনেই ৯ দিনের স্বাক্ষর করলেন কেন ? আবার সবদিনেই একই সময়ে এসেছেন - গিয়েছেন তা কিভাবে আপনার মনে থাকল ? কণিকা রানী জানান, আমাদের সকল সহকর্মীরাও একই ভাবে যাওয়া-আসার সময় লেখেন। তাই আমিও লিখি।
প্রতিবেদকদের দেখে তড়িঘড়ি করে হাজিরা রেজিষ্টারে আগমন ও প্রস্থানের সময় লিখতে গিয়ে পরবর্তী দিনের অর্থাৎ ২৪ তারিখের সহ স্বাক্ষর করে ফেললেন দুই শিক্ষক সুচিত্রা রানী ও কণিকা রানী।
উপস্থিতি রেজিষ্টারে নিয়মিত উপস্থিত অনুপস্থিত শিক্ষকদের তদারকি করা ও সি এল লেখার বিষয়ে অনীহার কারণ জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখর বলেন, আসলে শ্যামলী রানী আসেননি তা আমার মনে ছিল না। তাই লেখা হয়নি। পরের দিনও মনে ছিল না লিখতে। আসলে বয়স হয়েছে তো তাই প্রায়ই লিখতে ভুলে যাই।
অভিভাবক মোঃ মানিক জানান, তাদের ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে। কিন্তু প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে এসে পড়া লেখা বাদ দিয়ে খেলা-ধূলা, গল্পণ্ডআড্ডা আর সবজি বাগানে কাজ করে বাড়ি চলে যাচ্ছে।
অভিভাবক কমল কান্তি রায় বলেন, আমার শিশু শ্রেণীতে পড়া ৪ বছরের ছোট্ট ছেলেটি কয়েকদিন আগে বিদ্যালয় কক্ষের চটে অল্প একটু বমি করেছিল। কিন্তু স্কুলের শিক্ষিকা সুমিতা রানী আমার বউকে পূজা বাদ দিয়ে স্কুলে আসতে খবর পাঠায়। তড়িঘড়ি করে আমাকেও ডাকে। গিয়ে জানতে পারি আমাদের সন্তান অসুস্থ হয়েছে সেজন্য ডাকা হয়নি বরং চট ধুইয়ে দিতে ডেকেছেন শিক্ষকরা। বাধ্য হয়ে আমি দুইটি বড় বড় চট নদীতে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে দেই।
শিক্ষক সুমিতা রানীর কাছে অভিভাবককে চট ধোয়ার জন্য বাধ্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কি বমি নিজে ধোব? প্রধান শিক্ষকের নির্দেশেই আমি যা করার করেছি। আপনাদের যা মন চায় লেখেন।
অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রধান শিক্ষক মানব শেখর তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার হুমকি দেন বলে জানান স্কুলের আশেপাশের অভিভাবকরা। তারা জানান, মানব শেখরের দুর্নীতি অনিয়ম অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় উপরিচালক (প্রাথমিক শিক্ষা), ইউএনও বরাবর সুনিদৃষ্ট অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থ দিয়ে পরপর দুই বার তদন্ত কমিটিকে প্যাকেট করে নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টা করছে যাচ্ছে মানব শেখর।
প্রধান শিক্ষক মানব শেখর বলেন, আমার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। আমি সময়মতো এবং নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাই। বরাদ্দের চেয়ে বেশি টাকা ব্যায় করি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এসব স্বেচ্ছাচারিতার ডকুমেন্টস দেখে বিস্মিত হন ও নোট টুকে নেন। প্রতিদিনের আগমন, প্রস্তান নিয়মিত লেখা ও সিএল না লেখাটা নিয়ম বহির্ভূত কাজ। এ ছাড়া কোন অভিভাবকে চট ধুইয়ে দিতে বাধ্য করাটা অশোভনীয়। এ সময় দায়িত্বের অবহেলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন আঞ্জুমান আরা।
ইউএনও রাসেল মিয়া বলেন, আমি নিজেও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো করেছি। এ ধরনের অনিয়ম সত্যিই উদ্বেগ জনক। এর আগেও রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছিলাম। শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরাকে বিষয় গুলো তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছি। আমি নিজেই ওই প্রতিষ্ঠানে যাব।