অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে যমুনার চরের ছেলে-মেয়েরা। বাবা-মায়ের মতোই কোনোভাবেই পাচ্ছেনা শিক্ষার আলো। চর এলাকায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকাই ছেলে- মেয়েরা সকাল থেকে শুরু করে রাত প্রর্যন্ত বাবা মার সাথে গৃহস্থালী কাজে সহযোগীতা করেই সময় পার করছে তারা। শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন ধারনা না থাকায় দিন দিন তাদের প্রতিভা গ্রাস করে ফেলছে আদিকালের জীবন ব্যবস্থা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিল এলাকার বাসিন্দাদের ছেলে মেয়ে লেখা পড়ার দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠে। ঘুম থেকে জেগে ওঠে প্রস্তুতি নিতে হয় লেখা পড়ার। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মা কোমলমতি ছেলে মেয়েদের নিয়ে যেয়ে থাকেন শিক্ষালয়ে। ছেলে-মেয়েদের লেখা- পড়া শেখাতে বাবা মা কত কিছুই না করে থাকেন। ছেলে-মেয়ের শিক্ষা লাভের জন্য প্রানন্তকর চেষ্টা নিত্য দিনের হলেও, চর এলাকায় বাব-মায়ের ক্ষেত্রে ঠিক উলটো সেটি। এখানকার বাবা-মা’রা রাত পোহালেই সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করার জন্য নিয়ে যান কোমলমতি ছেলে মেয়েদের। গত শনিবার সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের তালতলা, কোমরপুর, মিলনপুর, চরমাটিয়ান ও বানিয়াপাড়া চর এলাকায় ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র, চরের ওই সব গ্রাম গুলোতে। এই ৫টি চরে নেই কোনরকমের বিদ্যালয়। বানিয়াপাড়া চর গ্রামে একটি মক্তব ঘর থাকলেও তা একেবারেই নরবড়ে। বর্তমানে বেতন বন্ধের কারণে সেটিও কয়েক বছর হলে বন্ধ রয়েছে। ঘরের দরজা-জানালা বলে কিছু নেই। বালুময় মেজে থাকলেও ঘরের চারপাশের নিচের অংশে নেই কোন বেড়া। বয়সকদের সাথে সকাল বেলা পান্তাভাত অথবা খুদসিদ্ধ খেয়ে ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে সহযোগীতা করছে চরের কৃষি কাজে অথবা মা’র সাথে বাড়ির বিভিন্ন কাজে কর্মে। খাঁ- খাঁ রোদ্র উপেক্ষা করে কাজ কাম করছে হরেক রকমের আবাদি জমিতে। আবার কোন শিশু-কিশোর ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, মোটরসাইকেল চালিয়ে অথবা রকমারি কষ্ট সাধ্য কাজ করে চলেছে তারা। মিলনপুর চরের ওয়াজ কুরুনির (১৫) সাথে কথা হয়। ওয়াজ কুরুনি সকাল থেকে শুরু করে রাত প্রর্যন্ত চরের পথ- ঘাটে ঘোড়া চালিয়ে দৈনিক ৮/৯ শ’ টাকা রোজগার করে থাকে। এই টাকা বাবা মা’কে সংসারের কাজে দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে। এছাড়াও ঘুম থেকে ওঠে প্রথমে ঘোড়ার পরিচর্যা করে সময় যায় তার। সে বলে কোন সময়েই আমি স্কুলে যাইনি। বাবা মা আমাকে কোন দিন যেতে বলেনি। কিভাবে বলবে, আমার বাবা মা’তো শিক্ষিত না। বাবা-মা শিক্ষিত হতো নিশ্চয় তারা আমাকে স্কুলে পাঠাতো। আর আমাদের চরে তো কোন স্কুল নেই যাবো কোথায় পড়তে?
বানিয়াপাড়া চরের মর্জিনা বেগম বলেন, আমাদের চরের ৫টি গ্রাম রয়েছে। একমাত্র বানিয়াপাড়া চরে রয়েছে ১২০টি পরিবার। প্রতিটি ঘরে ২/৩টি করে ছেলে মেয়ে রয়েছে। এই ৫টি চরে অন্তত প্রায় ৭ শতাধিক পরিবার রয়েছে। সে হিসাবে প্রায় ১ হাজার ৫ শ’ ছেলে মেয়ে রয়েছে। ২৬ বছর আগে আমরা এই চরে এসেছি, কিন্তু কোন বিদ্যালয় হয়নি এসব চরে।
মিলনপাড়া চর গ্রামের কাজী আজাদুল ইসলাম বলেন, চরে স্কুল আছে তবে তা ৪ কিলোমিটার দূরে বোহাইল ইউনিয়নের চর মাঝিড়ায়। ২/১ জন ছেলে-মেয়ে সেই স্কুলে গেলেও স্কুলে যাওয়ার কোন রাস্তা-ঘাট না থাকায় বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় স্কুলে যাওয়া যায় না। এছাড়াও শিক্ষকরা একদিন আসলেও সপ্তাহে ৫ দিন অনুপস্থিত থাকেন। আবার যদি থাকেনও তবে দুপুর ১২টাই এসে ২ টার মধ্যেই চলে যায় তারা। কিভাবে চরের লেখাপড়া হবে বলেন?
তালতলা চরের সোনাহার ইসলাম বলেন, চরের উন্নয়নের কথা বলেই অনেকেই অনেক প্রকল্প এনে থাকেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না করেই মোটা টাকা পকেটে তোলেন তারা। চরের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হলোও তা বাস্তবায়ন হয় না। চরের মানুষের লেখাপড়া কিভাবে সম্ভব? আমূল পরিবর্তন না আনলে শিক্ষার আলো তাদের কাছে পৌছিবেনা, চরের ছেলে-মেয়েদের কাছে।
এব্যাপারে কর্ণিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারমান আনোয়ার হোসেন দিপন বলেন, আমার ইউনিয়নের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত থাকলেও চরের মানুষের শিক্ষার জন্য কোন কাজ করেন না। চরের মানুষের রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় সেখানকার মানুষেরা অনেক কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন-করে থাকেন। শিক্ষাসহ জীবন যাত্রার মান বাড়াতে সরকারী উচ্চ মহলে ভাবা দরকার।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার শাহ ইলিয়াছ উদ্দীন বলেন, চরে স্কুল ছিল, তবে তা নদী ভাংগার কারণে বাঁধের উপর তোলা হয়েছে। ৪ বছর পূর্বে উপজেলা শিক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০টি স্কুল চরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে স্কুল কমিটির আদালতে বা কোর্টে মামলার কারণে তা সম্বভ হয়নি। যে কারণে উল্লিখিত চর গ্রামে স্কুলের প্রযোজন থাকলেও সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়াও শিক্ষকরাও চরে স্কুলে যায় না একথা ঠিকনা। তবে তারা ১২টার সময় গেলেও ২টার মধ্যে ফিরে আসেন এইটা তাদের পুরানো রোগ।