গত দুই মাসে রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স উভয়ই কমেছে। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে রপ্তানি আয় কমেছে। অক্টোবরের লক্ষ্যমাত্রা এবং গত বছরের একই মাসের তুলনায় রপ্তানি আয় কমেছে। অক্টোবরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০০ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৪৩৫ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১২.৮৭ শতাংশ। আর গত বছরের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৪৭৩ কোটি ডলার। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি বছরের একই মাসে আয় কমেছে ৮ শতাংশের বেশি। সেপ্টেম্বরে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৬.২৫ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৭৪২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে এক হাজার ৬৮৫ কোটি ডলার। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ৩.২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ব্যাংকিং চ্যানেলে গত অক্টোবরে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১৫২ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। আর গত বছরের অক্টোবরে এসেছিল ১৬৫ কোটি ডলার। ওই সময়ের চেয়ে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। যা আগের সাত মাসের তুলনায় সর্বনিম্ন ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৭২ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। এ বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে গত বছরের চেয়ে ১০.৮৪ শতাংশ কম।
ডলার সংকট বাড়বে, রিজার্ভ আরো কমবে
বাংলাদেশে ডলারের প্রধান উৎস রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। আর এটা দিয়েই রিজার্ভ তৈরি হয়। দেশের বাইরে থেকে আমদানিসহ দায়দেনা পরিশোধ করা হয়। আগামী ৮ নভেম্বর বাংলাদেশকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং হাউজের (আকু) এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দায় দেনা শোধ করতে হবে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৫.৫ বিলিয়ন ডলার। তখন সেটা ৩৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। আর যদি আইএমএফএর ঋণ পেতে তাদের মতো করে রিজার্ভের হিসাব করতে হয় তাহলে রিজার্ভ নেমে আসবে ২৬ বিলিয়ন ডলারে। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে। বাংলাদেশ তার পণ্যের ৮৩ ভাগই রপ্তানি করে ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার বাজারে। তাই সামনে রপ্তানি আয় আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান খাত তৈরি পোশাক। রপ্তানি আয়ের শতকরা ৮২ ভাগই আসে ওই খাত থেকে। নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমই-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ‘‘নিটওয়্যার খাতে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি ৬.১ ভাগ কমে গেছে। আগের মাসে রপ্তানি বেড়েছিল ২৫ শতাংশ। সেই হিসাব করলে সেপ্টেম্বরে আমাদের রপ্তানি কমেছে শতকরা ৩১ ভাগ।'' আর বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘‘গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের সাথে ডলার সংকট এবং ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা সংকটে আছি।'' এদিকে রেমিট্যান্সের ওপর নানা প্রণোদনা দেয়ার পরও হুন্ডির মাধমে অর্থ পাঠানো থামনো যাচ্ছে না। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসেবে, এই বছরের মে মাস পর্যন্ত দেশের বাইরে কর্মসংস্থান হয়েছে পাঁচ লাখ তিন হাজার ৯৭৯ জনের। আর গত বছরের এই একই সময়ে বিদেশে কাজের জন্য বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন এক লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ জন। চলতি বছরের পাঁচ মাসে জনশক্তি রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫৮ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানলে রেমিট্যান্সে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।
সামনে আরো চাপ আসবে
ইউএনডিপি বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের রপ্তানি আয় চাপের মুখে থাকবে। কারণ বাংলাদেশ তার রপ্তানি পণ্যের সিংহভাগ পাঠায় ইউরোপণ্ডঅ্যামেরিকার দেশগুলোতে। তারা মন্দার কারণে খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে পণ্য কম কিনছে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি সুবিধা হলো প্রধান রপ্তানি পণ্য হলো তৈরি পোশাক। সেখানেও কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও সেটা খারাপ অবস্থায় যাবে না। কারণ বাংলাদেশ বেসিক প্রডাক্ট উৎপাদন করে বেশি। এর চাহিদা থাকবে।'' অন্যদিকে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে কমলেও মোট রেমিটান্স যে কমেছে তা তিনি মনে করেন না। তার কথা, ‘‘ব্যাংক রেট এবং খোলা বাজারে ডলারের দামের উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকায় প্রবাসীদের মধ্যে হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বাড়ছে। এটা বন্ধ করতে হলে প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা আরো বাড়াতে হবে অথবা খোলা বাজারে ও ব্যাংকে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে।'' তিনি বলেন, ‘‘গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি লোক বিদেশে কাজের জন্য গেছেন। তাই রেমিট্যান্সও বেশি আসার কথা। সেটা ব্যাংকিং চ্যানেলে আনার ব্যবস্থা করতে পারলে রিজার্ভ বাড়বে।'' অন্যদিকে টাকার মান কমে যাওয়ায় তার প্রভাব রপ্তানিতে পড়ছে। কারণ রপ্তানিকারকদের একই হারে শুল্ক দিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘ধরুন আগে তাকে এক ডলারে ৮৫ টাকার ওপর শুল্ক দিতে হতো, এখন ১০০ টাকার ওপর শুল্ক দিতে হচ্ছে। তাতে তার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সরকার যদি আনুপাতিক হারে শুল্ক কমিয়ে দেয় তাহলে সরকারের আয় ঠিকই থাকবে, কিন্তু রপ্তানি আয় বাড়বে। আমদানির ক্ষেত্রেও তাই। এতে ডলারে খরচ কমবে। ডলার সাশ্রয় হবে।''
সংকট সমাধানের পথ কী?
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে পারে না। এভাবে চললে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। একটা পথ তো বের করতে হবে। আমাদের ডলার সংকটই এখন প্রধান সংকট। আর সেটাই রিজার্ভ কমিয়ে দিচ্ছে।'' তার কথা, ‘‘আমার বিবেচনায় সরকারের সামনে এখন তিনটি পথ আছে। বাজারের ওপর ডলারের দাম ছেড়ে দেয়া। যেখানে গিয়ে পৌঁছে। সরকার বাজারে ডলার ছাড়বে না। হয়ত এক ডলার ১২৫ টাকা হতে পারে। আরেকটা হলো যেভাবে চলছে সেভাবে ডলারের দাম সমন্বয় করতে থাকা। সরকার বাজারে ডলার ছাড়তেই থাকবে। সেটা হয়তো ছয় মাস পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া যাবে। তারপর ক্রাইসিস হবে। আর তিন নাম্বার হলো আইএমএফের ঋণ নেয়া তাদের শর্ত মেনে।'' তিনি বলেন, ‘‘আমার বিবেচনায় আইএমএফের শর্ত মেনে নিয়ে ঋণ নেয়াই ভালো। তবে এটা কেক ওয়াক নয়। মুখে বললেই হবে না। তাদের শর্ত মেনে ব্যাংক ও আর্থিক খাতসহ অর্থনীতির অনেক সংস্কার করতে হবে। বড় বড় কথা বললে তো হবে না, আমাদের ঋণ দরকার নেই, আমরা শর্ত মেনে নেব না। বাস্তবতা ভিন্ন।''