চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় দুটি প্রশ্নপত্র নিয়ে সম্প্রতি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে একটিতে রয়েছে সাম্প্রদায়িক উসকানি, অন্যটিতে রয়েছে সাহিত্যিককে হেয় প্রতিপন্ন করে উদ্ধৃতি। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে এইচএসসির বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নে। দ্বিতীয়টি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বাংলা দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নে। গত রোববার সারাদেশে এইচএসসি বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে বাংলা প্রথমপত্রের ১১ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপকে ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়, যা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্ন যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীনে মডারেট করা হয়েছিল। অন্যদিকে অপর প্রশ্নে জনপ্রিয় সাহিত্যিক আনিসুল হককে হেয় করাসহ বিভিন্ন বৈষম্যমূলক উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। রোববার কারিগরি বোর্ডের অধীনে এইচএসসি বাংলা-২-এর একটি সৃজনশীল প্রশ্নে উদ্দীপকে ওই লেখকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২১ শে বইমেলায় তাড়াহুড়ো করে তিনি বই প্রকাশ করেন। পাঠকদের কাছে তার লেখা খাপছাড়া মনে হয়। ফলে পাঠকদের কাছে তিনি সমাদৃত হন না। এ ছাড়া একই প্রশ্নপত্রে একজন নারীকে অবজ্ঞা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। সাম্প্রদায়িক উসকানির ঘটনায় জড়িত শিক্ষকদের বোর্ডে তলব করা করা হয়েছে। সাহিত্যিককে হেয় করার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা আশা করি, এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে এখানে বোর্ডের গাফিলতির কথাও সামনে আসে। শিক্ষক প্রশ্ন প্রণয়ন করার পর মডারেটররা সেটি যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করেন। এমন বিতর্কিত বিষয় থাকার পরেও কেন সেই প্রশ্ন গৃহীত হলো এবং সেটি পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হলো, তা জানা জরুরি। নাকি প্রশ্ন না দেখেই শুধু লটারির মাধ্যমে প্রশ্ন নির্ধারণ করে সেটি বিতরণ করা হয়েছে? আমরা আশা করবো, এ বিষয়েও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সবমিলিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটি হলো, এসব শিক্ষকের এমন অধঃপতনের কারণ কী? যাঁদের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান করার পাশাপাশি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ও ভালো-মন্দ চিনতে শেখানোই যখন তাদের দায়িত্ব, তখন তাঁরা নিজেরাই যদি কূপম-ুক হয়ে থাকে তখন তা জাতির জন্য বিপদজনক। দুই প্রশ্নপত্রের ঘটনায় যেটি ঘটেছে তা ন্যাক্কারজনক। প্রথমত, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে সক্রিয় ছিল এবং এখনও তারা তৎপর। তারা চায় ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে। এখন তাদের এজেন্ডাই কি বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে? শিক্ষকদের মধ্যে কি এই ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে? এর উত্তর খুঁজে বের করা খুবই জরুরি। এছাড়া একজন লেখকের জন্য মানহানিকর যে বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে সেটিও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মঙ্গলজনক নয়। ব্যক্তিগতভাবে একজন শিক্ষকের কোনো সহিত্যিকের সৃষ্টি পছন্দ না-ও হতে পারে। তবে তার জন্য তিনি সেটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বা আড্ডায়, অথবা ইচ্ছে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা গণমাধ্যমেও মত প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু কোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে নয়। এটুকু দায়িত্ববোধ না থাকলে একজন মানুষ প্রকৃত শিক্ষক হতে পারেন না। এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এটিকে টেনে তুলতে হলে প্রয়োজন যোগ্য মানুষ, দেশপ্রেমিক ও সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তি। সেখানে যাদের প্রতি প্রত্যাশা রাখা হয়, সেই শিক্ষকরাই যদি শিক্ষিত মানুষ হয়ে অশিক্ষিতের মতো কাজ করে তাহলে তা খুবই দুঃখজনক। আমরা আশা করি, দুটি প্রশ্নপত্রের অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তারচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষকদের অধঃপতনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং সমস্যার মূলে গিয়ে সমাধানের কাজ শুরু করতে হবে।