‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল ক্ষেতের ধান/সারামাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান/ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়/কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।’ কবি জসীমউদ্দীন এভাবেই কার্তিকের রূপের কথা বলেছেন তাঁর অমর সৃষ্টি কাব্যকাহিনী নক্সী-কাঁথার মাঠে। কবির সেই ধান পাকার গন্ধ আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে উপজেলার প্রতিটি এলাকায়।
কবির চোখের মতো করেই আজ দেখা যাচ্ছে ধানে ধানে ধান লেগে শব্দ বয়ে যাচ্ছে একটানা। আর পাকা ধানের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে একমনে আমন ধান কাটতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শেরপুরের কৃষকেরা। যেন নবান্নের আগমনী বার্তা বইছে কৃষকের ঘরে ঘরে।
বগুড়ার শেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চলতি রোপা-আমন মৌসুমে ২১ হাজার ৮৬০হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ২২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমি, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৯০হেক্টর বেশি। ১৫ নভেম্বর সোমবার দুপুর পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। যাহা রোপা-আমন মৌসুমের মোট আবাদি জমির ১৩ শতাংশ।
বগুড়ার শেরপুরে চাষ হওয়া রোপা-আমন ধানের বেশিরভাগই উচ্চ ফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের। এসব জাতের মধ্যে ব্রি ধান ৮৭ ও ৯০, বিনা ধান ১৭ সহ স্বর্ণা, ব্রি ধান-৪৫, রঞ্জিত, কাটারিভোগ ও স্থানীয় সুগন্ধি জাতের ধান চাষ হয়েছে। শুরুতে বৃষ্টির পানি নিয়ে শঙ্কা থাকলেও পরের আবহাওয়া ছিল আমন চাষের অনুকূলে, ফলে কোন দুর্যোগ ছাড়াই যদি কৃষকরা ঘরে ধান তুলতে পারেন তাহলে ফলন লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে বলে কৃষি কর্মকর্তা জানান।
চিরায়ত নিয়মে হেমন্তের মধ্যভাগে (১-অগ্রহায়ণ) নতুন ধান ঘরে তোলার পর বাঙালির নবান্ন উৎসব শুরু হয়। বাংলার কৃষক সমাজ প্রাচীন কাল থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসব পালন করতে ভুলে যায়নি আজও। গ্রাম বাংলায় কৃষকেরা নবান্ন উৎসব পরিপূর্ণ ভাবে উদযাপনের জন্য মেয়ে জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ীতে আমন্ত্রণ করে এনে নতুন চালের পোলাও, পিঠা ও পায়েসসহ রকমারী নিত্য নতুন খাবার তৈরী করে ধুম-ধামে ভুঁড়ি ভোজের আয়োজন চলছে।
এ বিষয়ে শেরপুর উপজেলার তালতা গ্রামের কৃষক আবদুল হামিদ বলেন, গ্রাম্য বধুরা জামাইকে সাথে নিয়ে বাপের বাড়ীতে নবান্ন উৎসব করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। নবান্ন উৎসবে গ্রামের কৃষকেরা মিলে-মিশে গরু, মহিষ ও খাঁসি জবাই করে। হাট-বাজারের বড় মাছ কিনে আনে। এই নিয়মের ধারাবাহিকতায় কৃষকদের ঘরে ঘরে চলছে এখন ঐতিহ্যবাহী নবান্ন আমেজ। বাড়িতে বাড়িতে চলছে ঐতিহ্যবাহী বাৎসরিক নবান্ন উৎসব পালনের প্রস্তুতি। এদিকে এবার হেমন্তের শুরুতেই ঘরে উঠছে আগাম জাতের ধান। নির্ধারিত সময়ের আগেই পাকা ধান যেমন ঘরে উঠছে, তেমনি সেই ধানের ফলনও হয়েছে তুলনামূলক ভালো। এ ছাড়া চালের বাজার দর হিসেবে নতুন ধানের বাজার দরেও খুশি কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাঃ ফারজানা আক্তার জানান, এ উপজেলায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে ৩৯০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। তাই আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। বেশ কয়েকদিন ধরে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে, এ বছর বাম্পার ফলনে ও বাজারে দাম বেশ ভাল পাওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকদের। চলছে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি।