খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতে খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু তারপরও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লাগামহীন থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের কাছে সরকারের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় খেলাপি ঋণের নীতিতে পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়েছে আইএমএফ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের এশিয়াবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে একই ধরনের মন্তব্য করে বলা হয়েছিল, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে গ্রাহককে অব্যাহতভাবে ছাড় দেওয়া হলে ব্যাংকের সম্পদ বা ঋণের মান কমে যাবে। উপরন্তু গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে উঠবেন। এর ফলে কোনো কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এতে আর্থিক খাতে সম্পদের মানে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা এ খাতকে বড় ধরনের দুর্বলতার দিকে নিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুয়ায়ী, কোনো ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের শেষদিন থেকে তিন মাস অতিক্রম হলেই তাকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছয় মাস করা হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সাল থেকেই মূলত ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যা ২০২১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক মন্দা প্রকট হওয়ার প্রেক্ষাপটে উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন খাতে ছাড় দেওয়া হয়েছে, যা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রায় তিন বছর ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের চাপ না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই এ ক্ষেত্রে তারা শিথিলতা দেখাতে পারেন, যা পরবর্তী সময়ে ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। ইতঃপূর্বে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। খেলাপি ঋণ না কমে বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা লোকজনের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম-জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, যা কঠোরভাবে রোধ করা প্রয়োজন। বস্তুত ঋণখেলাপিদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধতে ব্যাংক কোম্পানি আইন কঠোর করার পাশাপাশি এটি বাস্তবায়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ব্যাংক খাততে রক্ষায় খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।