দেয়ালে ফাঁটল, দুর্বল বেজমেন্ট ঢালাই, মেঝের ঢালাই উঠে গেছে, ঘরের ঢালাইয়ের নিচে ইটের সলিং নেই, বৃষ্টি হলে বাথরুমের ময়লা ঘরের ভিতর প্রবেশ করে, মেঝেতে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চির পরিবর্তে ১ থেকে ২ ইঞ্চি প্রদান এবং বাথরুমের রিং ৫টি বসানোর কথা থাকলেও কম দেওয়া হয়েছে। সিমেন্ট, বালি, রড, ইট ও খোয়া থেকে শুরু করে দরজা জানালায় ব্যবহার করা সামগ্রিও নির্মাণের। এমনকি ঢালাই কলম রিংও নির্ধারিত পরিমানের চেয়ে এক ইঞ্চি কম করা হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত বালি দিয়ে ঘরের মেঝে উঁচু না করায় সামান্য বৃষ্টিতেই এসব ঘরে পানি জমে যায়।
অপরদিকে, উপজেলায় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি, মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণের জন্য ভরাটকৃত জমি এবং মাদ্রাসা ও ইয়াতিম খানার লীজ দেয়া জমিতে ব্যবসার জন্য বালু রাখা হলেও কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সেখানে প্রধানমন্ত্রী’র উপহারের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের এসব চিত্র খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষের জন্য নির্মাণকৃত বসতঘরের। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী’র উপহার স্বরূপ এসব ঘর তৈরি করা হয়েছে। এ প্রকল্পে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি কমিটি রয়েছে। যার সদস্যরা হলেন উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তদারকি করছে প্রধানমন্ত্রী’র কার্যালয়। এদিকে, উপহার স্বরূপ গৃহহীন ও ভূমিহীনদের এসব ঘর বরাদ্দ করা হলেও নিরাপদের পরিবর্তে সংশ্লিষ্টদের জন্য ঘরগুলো বসবাস ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দেয়ালে ফাঁটল ধরায় বসবাসকারীরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে সারাক্ষণ ভয় ও আতঙ্কে থাকেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, দিঘলিয়া উপজেলায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে প্রথম পর্যায়ে ৭০টি, একই অর্থ বছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩০টি, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে তৃতীয় পর্যায়ে ১শ’টি এবং ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে চতুর্থ পর্যায়ে চলমান ১০২টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ের প্রতিটি ঘর নির্মাণ বাবদ ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিটি ঘর নির্মাণ বাবদ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা, তৃতীয় পর্যায়ের ২ লাখ ৪০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা এবং চতুর্থ পর্যায়ে প্রতিটি ঘর নির্মাণ বাবদ ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ঘর নির্মাণের অলিখিত ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের ম্যাকানিক রাসেল কাজী। উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাগ্নে হওয়ার সুবাদে অবৈধ প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে একজন সরকারি কর্মচারী হওয়া স্বত্বেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুল আলম তাকে দিয়েই কাজ করাচ্ছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাগ্নে হবার সুবাদে ঠিকাদার রাসেল কাজী যা খুশি তাই করে রীতিমত নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ফলে অনিয়ম-র্দুর্নীতির বিষয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাঁচ্ছেন না। বিনিময়ে একদিকে সরকারি চাকরি, অন্যদিকে ঠিকাদারির মোটা অংকের সরকারি অর্থ পকেটে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছেন রাসেল। সূত্র জানান, উপহারের ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত ঘরগুলো দৃষ্টিনন্দন রঙিণ টিনের দুই কামরার সেমিপাকা হবে। প্রতিটি ঘরের আয়তন-দৈর্ঘ্য ১৯ ফুট ৬ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। সঙ্গে রান্নাঘর ও শৌচাগার থাকবে। প্রতি ১০ ঘরের জন্য একটি নলকূপ। সব মিলিয়ে বাড়ি প্রতি খরচ ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ইটের সংখ্যা, সিমেন্ট ও বালুর পরিমাণও বলে দেওয়া হয় নকশা মোতাবেক। নির্দেশিকা অনুসারে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর সঙ্গে কোন মিল নেই। প্রকল্পের জন্য নামমাত্র একটি কমিটি থাকলেও কমিটির সদস্যদের ঘর তৈরির বিষয়ে নজরদারি এবং অনিয়ম নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা পরিলক্ষিত হয়নি। অপরদিকে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দিঘলিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ তাদের দখলীয় খাস জমিতে লীজ দিয়ে বালুর ব্যবসা করছিল। কিন্তু তাদের রাখা বালুর মূল্য পরিশোধ না করেই সেখানে প্রধানমন্ত্রী’র উপহারের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেও কোন ক্ষতিপূরণ পাননি। বালু ব্যবসায়ী সেলিম মোড়ল বলেন, তারা ৪জন শেয়ারে মাদ্রাসা ও ইয়াতিমখান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লীজ নিয়ে ওই খাস জমিতে বালুর ব্যবসা করছিলেন। সেখানে আনুমানিক ৮/৯ লাখ টাকার বালু ছিল। কিন্তু তাদের সেখান থেকে বালু সরিয়ে নেয়ার সুযোগ না দিয়েই সেখানে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাদেরকে ৬ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলেও দেড় বছর হলেও তা প্রদান করা হয়নি। একইভাবে উপজেলার কেটলা এলাকায়ও মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণের জন্য ডিসিআর প্রাপ্ত জমিতে খাস জমিতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বালু ভরাট করা হয়। কিন্তু সেখানেও কোন ধরণের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী’র উপহারের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
কেটলা মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণের উদ্যোক্তাদের একজন এসএম সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, এলাকায় মসজিদ এবং ঈদগাহ না থাকায় এলাকাবাসীর নামাজ আদায়ে সমস্যা পড়তে হয়। এ কারণে সবার সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা ডিসিআরের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে ওই খাস জমিতে মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণের জন্য স্থানীয় মুসল্লিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বালু ভরাট করি। কিন্তু সেখানে প্রধানমন্ত্রী’র উপহারের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি তাদের টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি। এতে এলাকার সাধারণ মুসল্লিরা হতাশ হয়েছেন। তবে, ওই জায়গা না পেলেও সম্প্রতি স্বল্প পরিসরে ছোট্ট আকারে একটি মসজিদ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। অপরদিকে, উপজেলার ব্রক্ষগাতী গ্রামে ইবনুল হাসান মিনারের ক্রয়কৃত ৪ শতাংশ জমিতেও সরকারি ঘর নির্মাণ করে অপর একজনের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। বিষয়টি জানতে পেরে জমি মালিক মিনার ওই ঘর উচ্ছেদের আবেদন জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু তিনি কোন সমাধান না পেয়ে স্বল্প মূল্যে স্থানীয় একজনের কাছে ওই জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন ইবনুল হাসান মিনার। ঝামেলায় জড়ানোর আশংকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপহারের ঘরে বসবাসকারী উপকারভোগীরা বলেন, অধিকাংশ ঘরের দেয়ালে ফাঁটল ধরেছে। ঘরের মেঝে নিচু, ঢালাই উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে ঘরে পানি ঢুকে যায়। বালতি দিয়ে পানি তুলে বাইরে ফেলতে হয়। এমনকি বাথরুমের প্যান দিয়ে পানি উঠে ময়লা ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। এসব বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বারস্থ হলে তারা কোন পদক্ষেপ নেননি, বরং দুর্ব্যবহার করে থামিয়ে দিয়েছেন। এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুবই ঝুঁকির মধ্যে এসব ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, নামমাত্র মাটি খুঁড়ে তৈরী করা হয়েছে ভূমিহীনদের ঘরগুলো। নির্মাণ কাজ চলার সময় আশপাশের কোন লোককে প্রকল্পের ধারে কাছে আসতে দিতো না নির্মাণকারীরা। বালু ও সিমেন্টের মিশ্রনে নামমাত্র সিমেন্ট দেওয়া হতো। ঢালাই কাজে ব্যবহার করা হয় নিন্মমানের খোয়া এবং বালু। আর রড কোথাও আছে আবার কোথাও নেই। ঘরের মেঝেতে সিসি ঢালাই ৩ ইঞ্চি ধরা থাকলেও ১ থেকে ২ ইঞ্চি ঢালাই দিয়ে কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। স্থানীরা আরও বলেন, এ প্রকল্পের কাজ চলার সময় দায়িত্বশীল কোন লোকের তদারকি না থাকায় নিন্মমানের উপকরণ দিয়ে তৈরী করা হয় ঘর গুলো। যা নির্মাণ হতে না হতেই ঘরের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নির্মাণ কাজে যুক্ত এক শ্রমিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, রাসেল নামে এক ঠিকাদার তাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। আমাদের যে মালামাল দিয়ে কাজ করতে বলা হয় আমরা তা দিয়েই কাজ করি। ভাল-মন্দ তাদের ব্যাপার। আমরা নিজেরাও জানি কাজটি খুব খারাপ হচ্ছে, তারপরও আমাদের কিছুই করার নেই। আমরা রোজ হিসেবে টাকা পাই আর কাজ করি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অফিস স্টাফদের দিয়ে ৭জনের তদারকি কমিটির মাধ্যমে উপহারের ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের ম্যাকানিক রাসেল কাজীকে কাজ দেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি। তবে রাসেল কাজী ঠিকাদারি কাজ করছে বলে তার স্বীকারোক্তির বিষয়টি তাকে অবহিত করা হলে তিনি বলেন, ‘রাসেল স্বীকার করলে আর কি বলবো বলেন’। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুবুল আলম বলেন, এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ করতে ঠিকাদার নিয়োগের কোন নির্দেশনা নেই। ৫ জনের একটি প্রকল্প কমিটি আছে, যার সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা নিজেই ঘরের মালামাল কেনা-কাটা এবং কাজ দেখা শোনা করেন। এ ছাড়া আমাদের একটি কারিগরি কমিটিও করা হয়েছে কাজ দেখা শোনার জন্য। ঘরগুলো নিচু স্থানে করার বিষয়ে তিনি বলেন, কেটলার পাশের জমির মালিক ড্রেনের মুখ আটকে রাখার কারণে টানা বৃষ্টির জন্য সেখানে পানি জমেছিল। তখন নিরালায়ও হাঁটু পানি জমেছিল। সমস্যার সমাধান করা হয়েছিল সাথে সাথেই। স্থায়ী সমাধানে ড্রেনের কাজও শুরু হচ্ছে। তবে ঘরগুলোর অনিয়ম ও ক্রটি থাকলে তাকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি। দিঘলিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানার দখলীয় খাস জমিতে বালু ভরাটের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতি পূরণের অর্থ দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। বালুগুলো ছিল নদীর ড্রেজারের কাটা। মাদ্রাসা ও ইয়াতিমখানার কাছ থেকে লীজকৃত টাকা আমরা ফেরত দিয়েছি। পরে আমরা আবারও বালু দিয়ে ভরাট করছি। তিনি বলেন, ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় তো ঘরই হয় না, তারপর আমরা অতিরিক্ত টাকা কি করে দিব। অতিরিক্ত বালু কিনে নেয়ার ফান্ড নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি।