মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে পরিবারের তিন সদস্যকে হারানোর সেই নির্মম স্মৃতি মনে করে আজো আঁতকে ওঠেন স্বজনেরা। তবে তাদের কাছে আত্মতৃপ্তি, ইতিহাসের সাক্ষী স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঠানো দরদ মাখা সমবেদনা ও আর্থিক অনুদানের সেই চিঠি।
এই গর্ব বরিশালের গৌরনদী উপজেলা সদরের টিকাসার গ্রামের দেবনাথ পরিবারের। বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সমবেদনা ও অনুদানের সেই চিঠিগুলো টানা ৫১ বছর ধরে স্মৃতিবহন করে চলছে দেবনাথ পরিবারে। শত অভাবের মাঝেও তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর প্রদান করা অনুদানের টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করেননি দেবনাথ পরিবারের সদস্যরা। বরং স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫১ বছর পর আজো বঙ্গবন্ধুর সেই চিঠি উত্তরসূরীদের জন্য স্মৃতি হিসেবে পরম যতেœ রেখেছেন দেবনাথ পরিবার।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক সেনাদের নির্মম বুলেটে শহীদ হয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের দেবনাথ পরিবারের তিনজন পুরুষ সদস্য। পাশাপাশি একজন নারী সদস্য অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে দেশ স্বাধীনের পর শহীদ পরিবার হিসেবে ওই পরিবারের সদস্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত দুইটি সমবেদনা ও অনুদানের চিঠি পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর দেওয়া দুইটি চিঠির মধ্যে একটি চিঠি শহীদ রাধা গোবিন্দ দেবনাথের স্ত্রী চন্দ্রাবলী দেবনাথের কাছে লেখা ছিল। ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট ইস্যুকৃত বঙ্গবন্ধুর দরদ মাখা চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হল-প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সহিত জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসনের নিকট দুই হাজার টাকার চেক প্রেরিত হল। চেক নম্বর সিএ ০০২৩৯১। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন। ইতি-শেখ মুজিব।
সূত্রমতে, একইভাবে ১৯৭৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ইস্যুকৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ রামেশ্বর দেবনাথের স্ত্রী গীতা রানী দেবনাথের কাছেও অনুরূপ সমবেদনা ও অনুদানের চিঠি প্রেরণ করেছিলেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টু বলেন, ১৯৭১ সালের ১১ জৈষ্ঠ্য স্থানীয় রাজাকারদের উপস্থিতিতে পাকসেনারা টিকাসার গ্রামের বাসিন্দা দেবেন্দ্র কুমার দেবনাথ, তার বড় ছেলে রাধা গোবিন্দ দেবনাথ ও সেজ ছেলে রামেশ্বর দেবনাথকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যার পর বাড়ির পাশ্ববর্তী খালের পানিতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। এ ছাড়া বাড়ির নারী সদস্যদের পাকসেনারা অমানবিক নির্যাতন করে।
তিনি আরও বলেন, স্বামী ও দুই ছেলেকে হারিয়ে এবং নিজে নির্যাতিত হয়ে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে মাত্র একমাসের ব্যবধানে মৃত্যুবরণ করেন শহীদ দেবেন্দ্র কুমার দেবনাথের স্ত্রী চন্দ্রাবতী দেবনাথ। ওইসময় চন্দ্রাবতীর সৎকার অতিগোপনে তাদের পরিবারের সদস্যরা করেছিলেন।
শহীদ রাধা গোবিন্দ দেবনাথের ছেলে নারায়ণ দেবনাথ মনু (৭২) বলেন, স্বজনদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গমন করি। এখবর পেয়ে স্থানীয় রাজাকাররা আমাদের ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যায়। এ ছাড়া রাজাকাররা ওইসময় গৌরনদীতে হিন্দু নিধন অভিযানের নামে টিকাসার গ্রামের গৌর কুন্ডু, সুধীর বণিকসহ অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা এবং বাড়িঘরে লুটপাট করে অগ্নিসংযোগ করে।
নারায়ন দেবনাথ আরও বলেন, এসবের বিনিময়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবার হিসেবে আমাদের চিঠির মাধ্যমে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং প্রত্যেক শহীদ পরিবারের জন্য দুই হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর অদ্যাবধি আর কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। শহীদ পরিবার হিসেবেও আর আমরা স্বীকৃতি পাইনি।
ক্ষোভের সাথে নারায়ন দেবনাথ বলেন, শহীদ পরিবার হিসেবে আমরা স্বীকৃতি তো পাইনি বরং একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও আমার নাম আজও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
নারায়ন দেবনাথের স্ত্রী লহ্মী দেবনাথ বলেন, স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আজও বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত দরদ মাখা সমবেদনা ও অনুদানের সেই চিঠিগুলো পরম যতেœ রেখেছি। শহীদ পরিবারের উত্তরসূরী বাবু দেবনাথ ও শিপ্রা দেবনাথ বলেন, পরিবারের তিনজন সদস্য শহীদ হওয়ার পর আজও আমরা শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। তবে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত চিঠিগুলোই আমাদের কাছে অনেক বড় স্বীকৃতি বহন করে চলছে। যা এখন ইতিহাসের গৌরবময় স্বাক্ষী।
শহীদ পরিবারের প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই ভালোবাসা বর্তমান প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা দাবি করে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, যুদ্ধবির্ধ্বস্ত দেশে অজপাড়া গাঁয়ের শহীদ পরিবারকে সমবেদনা ও আর্থিক সহযোগিতা করতে বঙ্গবন্ধুর এই চিঠির মাধ্যমেই বোঝা যায় তিনি কতবড় মনের এবং বড় মাপের মানুষ ছিলেন।