১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জামালপুর জেলার বকসিগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ঐতিহাসিক দিন ৪ ডিসেম্বর। এইদিনে মুক্তিযোদ্ধের ১১নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ধানুয়া কামালপুর পাকহানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে পর্যায় ক্রমে ১২ডিসেম্বরের মধ্যে সারা জেলায় শত্রু মুক্ত হয়।
৭মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দিয়ে তৎকালিন জামারপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। পাক সেনাদের বিরোদ্ধে দেশ-মাতৃভূমি রক্ষায় তরুণ টকবগে সূর্য্য সন্তানরা একের পর এক মহান মুক্তিযোদ্ধে যোগ দিতে থাকে। বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অর্ন্তগত মহেন্দ্রগঞ্জ এক কিলোমিটার অদূরে অবস্থিত। তাই মহেন্দ্রগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে বেছে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের ১১নং সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপিত করা হয়ে ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসূত্রে জানাযায়, ১১নং সেক্টরটি জেড ফোর্সে নামে গঠন করা হয়েছিল। জেড ফোর্সের প্রথম সেক্টর কমান্ডার পদে দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ১১নং সেক্টরের অধিনে নিয়মিত বাহিনী ছিল ৩ হাজার এবং গনবাহিনী ছিল ১৯ হাজার। মোট ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হয়ে ছিল ১১ নং সেক্টর। কিন্তু ধানুয়া কামালপুর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিঃমেন্ট পাকসেনাদের দূর্ভেদ্য সুরক্ষিত একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। তাই প্রথম দিকে মেজর জিয়া দায়িত্ব পালন কালে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা তেমন কোন সাফল্য দেখাতে পারেননি। তাই ৭১এর ১১আগষ্ট মিত্রবাহিনীর হাইকমান্ডের নির্দ্দেশে ১২আগষ্ট থেকে কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)কে ১১নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার পদে নিযুক্ত করেন। কর্নেল আবু তাহের দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমে মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, ডালু, বাগমারা, শিববাড়ী, রংড়া, এবং মহেশখোলা এই ৮টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। জানাযায় কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম) এ অঞ্চলে পাক সেনাদের বিরোদ্ধে কমপক্ষে ১০বার সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ছিলেন। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্পে তার নেতৃর্ত্বে তুমুল আক্রমণ শুরু করেন। কিন্তু ওইদিন যুদ্ধ চলাকালে পাকসেনাদের মর্টার সেলের আঘাতে কর্নেল আবু তাহেরের বাম পা উডে যায়। পরবর্তি ১৫নভেম্বর মিত্র বাহীনীর হাইকমান্ডের নির্দ্দেশে ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার পদে উইংকমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান(বীর প্রতিক)কে স্থলাভিশিক্ত করেন।
উইংকমান্ডার হামিদুল্লাহ খান (বীর প্রতীক) সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে তিনি ৭১এর ৩ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর সদস্য নিয়ে একযোগে ধানুয়া কামালপুর পাকসেনা ক্যাম্প ঘিরে ফেলেন এবং তার নির্দ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহম্মেদ (বীর প্রতীক) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জ ু(বীর প্রতীক) এই দু’জন জীবনের মায়া ত্যাগ করে আত্মসমাপন পত্র নিয়ে বীরদর্পে পাকসেনা ক্যাম্পে উপস্থিত হন।
পত্র পেয়ে পাকসেনা কমান্ডার গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিক অগ্নিমূর্তি ধারন করে দু’জনকে বেধড়ক পিটুনী নির্যাতন চালিয়ে শরীরে টাইম বোম লাগিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখেন। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যোদ্ধারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হন।
সেই যুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন সালাউদ্দিন তার দলের মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে প্রাণপন লড়াই করে পাকসেনা ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছান। কিন্তু হঠাৎ তার দলের ওয়ারলেসটি (বেতার) অকেজু হলে মুক্তিবাহীনী ও মিত্র বাহিনীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এ সময় ভূলবসত মিত্রবাহিনীর সদস্যরা পেছন থেকে তাদেরকে লক্ষ করে সেল নিক্ষেপ করতে থাকলে সেলের আঘাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপটেন সালাউদ্দিনসহ বেশ কিছু সহযোদ্ধা অকুস্থলে শাহাদৎ বরণ করেন। সারা রাত সংর্ঘষের পর অবশেষে ৪ ডিসেম্বর/৭১ ভোরে পাকিস্থাানী গ্যারিসন অফিসার আহসান মালিকসহ মোট ১শ ৬২ জন বেলুচ, পাঠান ও পাঞ্জাবী শত্রুসেনা আত্মসমর্পণ করে। তৎকালিন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার অর্ন্তগত দেওয়ানগঞ্জ থানার ধানুয়া কামালপুর বর্তমানে বকসিগঞ্জ উপজেলার ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নটি ৪ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হয়। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা বশির আহম্মেদ (বীর প্রতীক) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধ সঞ্জু উভয়ে স্বাধীনতার লাল সবুজের বিজয়ী পতাকা প্রথম ধানুয়া কামালপুরের মাটিতে উত্তোলন করেন। ওই যুদ্ধে মোট ৪শ ৯৭জন বীর মুক্তি যোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্য ঘটনাস্থলে শহীদ হন। ধানুয়া কামালপুর বিজয়ের পর মুক্তিযুদ্ধাদের মনোবল ও আত্ম বিশ্বস বৃদ্ধিপায়। ফলে ৫ ডিসেম্বর বকসিগঞ্জ ৬ ডিসেম্বর দেওয়ানগঞ্জ, ৭ ডিসেম্বর ইসলামপুর, ৮ ডিসেম্বর মেলান্দহ, ১০ ডিসেম্বর জামালপুর সদর এবং ১২ ডিসেম্বর সরিষাবাড়ী থানা শত্রু মুক্ত হলে সারা জেলায় একযুগে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা পৎ পৎ করে উড়তে থাকে।
এ উপলক্ষে ধানুয়া কামালপুর ৪ডিসেম্বর স্মৃতিচারণ করতে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে অংশগ্রহণ করবেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আখম মোজাম্মেল হক এমপি বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন,ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলহাজ ফরিদুল হক খান দুলাল এমপি, স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।