আবারও আলোচনায় আসছে কুড়িগ্রামে বহুল আলোচিত সোনালী খাতুনের মুক্তিযোদ্ধা শ্বশুরকে পিতার পরিচয় এবং শ্বাশুড়ীকে মাতা পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরীর অপকর্ম। এবার সোনালী খাতুনের বিরুদ্ধে এনআইডি সনাক্তকারীরা স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ তুলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন উপজেলা নির্বাচন অফিসে।
অভিযোগকারী সাবেক ইউপি সদস্য ও বীরমুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী জানান, সোনালী খাতুনের জাতীয় পরিচয়পত্রে যাচাইকারী হিসেবে আমার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যা আমার জানা ছিল না। তদন্ত কমিটি আমার কাছে আসার পর আমি বিষয়টি সম্পর্কে পরিস্কার হই। আমি কখনো তার এনআইডিতে সনাক্তকারী ছিলাম না। সেই সময়ে তথ্য সংগ্রহকারী নাগেশ্বরী উপজেলার নাখারগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আশরাফ আলী খন্দকার পরস্পর যোগসাজসে আমার স্বাক্ষর জাল করেছেন। বিষয়টি এক্সপার্টদের দিয়ে যাচাই করা দরকার। যাতে দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পান।
একই কথা জানালেন অপর সনাক্তকারী আনছার বাহিনীর সদস্য হাসান আলী। তিনি জানান, আমি ব্যক্তিগতভাবে সোনালী খাতুনকে চিনতাম না। কিন্তু এক ইউপি সদস্যের মাধ্যমে জানতে পারি সোনালী খাতুনের ভোটার হালনাগাদ ফরমে সনাক্তকারী হিসেবে আমার স্বাক্ষর দেয়া আছে। সেই স্বাক্ষর দেখি জাল করা হয়েছে। সোনালী খাতুনের বাড়ি থেকে আমার বাড়ি এক কিলোমিটার দূরে। কিভাবে আমি তার প্রতিবেশি হয়ে স্বাক্ষর করবো? যে আমার স্বাক্ষর জাল করেছে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেবার দাবী জানান তিনি।
গত ১২ ডিসেম্বর সোমবার বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ইউপি সদস্য আকবর আলী এবং বুধবার ১৪ ডিসেম্বর আনছার বাহিনীর সদস্য হাসান আলী লিখিত অভিযোগ দেন।
এদিকে স্বাক্ষর জালের ঘটনা অস্বীকার করে তথ্য সংগ্রহকারী আশরাফ আলী খন্দকার জানান, প্রায় ৮-১০ বছর আগের ঘটনা। পুরোটা আমার মনে নেই। তাছাড়া স্বাক্ষর কমবেশী হতে পারে। আপনারা ভালো করে যাচাই করে দেখেন।
বিষয়টি নিয়ে নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আমি বর্তমানে রংপুরে নির্বাচন কাজে ব্যস্ত রয়েছি। কাজ শেষে উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের কুটি নাওডাঙ্গা আমিরটারী তালবেরহাট গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আইনুল হক ও জমিলা বেগম দম্পতির প্রথম পূত্র আনিছুর রহমানের স্ত্রী সোনালী খাতুন। সোনালী খাতুন পাশর্^বর্তী উলিপুর উপজেলার গুনাইগাছ ইউনিয়নের নাগড়াকুড়া গ্রামের মৃত: রবিউল ইসলাম ও আছমা বেগমের সন্তান। ২০০৭ সালে তাদের বিয়ে হয়। তথ্য গোপন করে তিনি ২০১৪ সালে ভোটার হালনাগাদের সময় ভোটার ফরম নং-২৯০৯৪৫৮৪ এবং ভোটার এলাকা নং-০১৬৮নাম্বারে ভোটার হন। সেই ফরমে যাচাইকারী ওই ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক দুই বারের ইউপি সদস্য আকবর আলী এবং একই ওয়ার্ডে বাসিন্দা আনছার বাহিনীর সদস্য হাসান আলীকে সনাক্তকারী হিসেবে দেখানো হয়। সেখানে তাদের দু’জনের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং স্বাক্ষর দেয়া হয়। অথচ বিধি অনুযায়ী ভোটার তথ্য ফরমের যাচাইকারী কলামে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এবং সনাক্তকারীর হিসেবে প্রতিবেশীর জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার ও স্বাক্ষর থাকার নিয়ম। কিন্তু এখানে সেটা করা হয় নাই। শুধু এনআইডি জালিযাতি নয়। এর পাশাপাশি ২০১০-২০১১ সেশনে অনিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে উপজেলার সাপখাওয়া দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন সোনালী খাতুন। সেখানেও তিনি পিতা-মাতার পরিচয় গোপন করে শ্বশুর ও শ্বাশুড়ীকে পিতা-মাতার পরিচয় দিয়ে ২০১৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে আসলে সংবাদ প্রকাশের পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরপর চলতি বছর ১১ অক্টোবর কুড়িগ্রাম চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোনালী খাতুন নিজের ও তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ির নাম পরিবর্তন করে তার প্রকৃত পিতা-মাতার নাম দিয়ে হলফনামা করতে যান। তার দাখিলকৃত কাগজপত্রে তিনি নাম ও জন্ম তারিখ ১৯৯৪ সালের বদলে নতুন জন্ম তারিখ ১৯৯০ সাল দেখিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে একটি জন্ম সনদ দাখিল করেন। সরবরাহকৃত সব সরকারি কাগজপত্র তৈরিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ায় আদালত সোনালী খাতুনকে কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে এবং আদালতের বেঞ্চ সহকারীকে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশনা দেয়। সে অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয় এবং জেল হাজতে রয়েছেন সোনালী খাতুন।