বাঙ্গালি জাতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ স্বাধিনতাকামী মানুষের একটি রক্তাক্ত স্মৃতির ইতিহাস। জনসাধারনের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গড়ে তুলতে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলো বিশেষ করে গণকবর ও বধ্যভূমি গুলো সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবহিত করা প্রয়োজন হয়ে উঠেেছ। বিজয়ের ৫১ বছর ধরে আজও নানা অসুবিধার কারণে শেরপুরের সেই সব স্মৃতিচিহ্ন, গণকবর ও বধ্যভূমি গুলো অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী দেশ জুড়ে চালিয়েছে বিভৎস হত্যাযজ্ঞ। পাক হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন শেরপুরের অসংখ্য নারী-পুরুষ। গণহত্যার পর কোথাও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কোথাও হত্যাযজ্ঞের পর স্থানীয় লোকজন লাশগুলো দাফন ও সৎকারও করেছেন। কিন্তু দেশ স্বাধিনের ৫১ বছরেরও ওইসব বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে কারণে আজও নিরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান, গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।
নালিতাবাড়ীর নাকুগাঁও: ১৯৭১ সালের ২৫ মে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তের ভোগাই নদী পার হয়ে পাকহানাদার বাহিনী ভারতের বারাঙ্গাপাড়া থানার ডালুতে গণহত্যা চালায়। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে ডালুতে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিকামী মানুষ ও ভারতীয় নাগরিকসহ ২ শতাধিক নারী-পুরুষ নিহত হয়। পাক হানাদারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৯ জন বিএসএফ সদস্য। ভারতের কাটাতার ঘেঁষা নাকুগাঁওয়ে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশিদের লাশ দাফন করা হয়। এছাড়াও ৯ মাসে ওই স্থানে বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কবর দেয়া হয়। স্বাধিনতার পর ভারত সরকার তাদের বিএসএফ সদস্যদের স্মরণে তাদের জায়গায় একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে। সেটিকে আরও বৃহৎ আকারে সংস্কার করে স্মৃতিস্তম্ভটি পুনঃনির্মাণ করে ভারত সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের অংশে নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁওয়ের গণকবরটি এখনও অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে। উল্লেখ্য, সীমান্ত ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ এলাকা হওয়ায় সেখানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে দায়িত্বশীলদের পক্ষ হতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ওই বধ্যভুমির আশপাশে বাংলাদেশ অংশে অনেক বাড়ি-ঘর এবং ভারতীয় অংশের বধ্যভূমিকে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে সিমেন্ট ও কংক্রিটের পাইলিং তৈরি করা হয়েছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করতে নানা অসুবিধা ও কারণ তৈরির অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
নালিতাবাড়ীর তন্তর গ্রাম : নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া-মন্ডালিয়াপাড়া ইউনিয়নের তন্তর গ্রামটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন পাকহানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকারদের নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। ওইসময় ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৭ জন শহীদ হন। কিন্তু গ্রামবাসীদের অপরিসীমত্যাগ ও শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ-আয়োজন সেখানে নেই আজও।
নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকুড়া ফরেস্ট ক্যাম্প : নালিতাবাড়ী উপজেলার ফরেস্ট ক্যাম্পটি ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি। যুদ্ধের ৯ মাস এখানে বহু মানুষকে নির্য়াতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। ওই ফরেষ্ট ক্যাম্পে একটি পানির কুপ ছিল। স্বাধীনতার পর সেখানকার কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য কঙ্কাল। কালের সাক্ষী হিসাবে ওই ক্যাম্পটি আজ স্মৃতিময়। কোন স্মৃতিচিহ্ন সেখানে আজও নেই।
কাঁটাখালি ব্রিজ এবং রাঙ্গামাটি-খাটুয়ামারি গ্রাম :
শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজটিই ছিল তখন সীমান্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তাই পাকহানাদারদের সীমান্ত এলাকায় অবাধ যাতায়াত বন্ধ করতে ওই ব্রিজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু পর পর দু’বার অপারেশন করেও সফল না হওয়ার পর ওই ব্রিজ অপারেশনে আসেন নালিতাবাড়ীর কৃতী সন্তান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্র্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান। ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই রাতে তিনি তার ৫৩ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাঁটাখালি ব্রিজ এবং তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে ঝিনাইগাতীর রাঙ্গামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে আশ্রয় নেন। ৬ জুলাই সস্মুখ যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। তবে এই ব্রীজ এড়িয়ায় কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি এখনও।
ঝিানাইগাতির জগৎপুর : ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রামে ১৯৭১ সনের ৩০ এপ্রিল গণহত্যা চালানো হয়। সেদিন ওই গ্রামের ৪২ জন হিন্দু পরিবারের সদস্যসহ মোট ৫৮ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করা হয়। পুড়ে ছারখার করে দেয়া হয় বাড়িঘর। গণহত্যার ওই স্থানটিতে স্মৃতিস্তম্ভ বা শহীদদের স্বীকৃতি দেয়ার কোনো উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি।
শেরপুর সূর্যদি গ্রাম : চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন আগে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ঘটে এক নারকীয় গণহত্যা। ১৯৭১ সনের ২৪ নভেম্বর ওই গ্রামে পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের নারকীয় হত্যাকান্ডের শিকার হন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী। এখানে শহীদদের কবর সংস্কার কিংবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি।
অন্যান্য : শেরপুর শহরের শেরীব্রিজ, সুরেন্দ্র সাহার বাড়ির আলবদরদের টর্চার সেল, সদর থানার সামনে অ্যাডভোকেট এম এ সামাদ সাহেবের বাড়ির বধ্যভূমি, জেলা প্রশাসকের বাংলোর পাশে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির কার্যালয়, ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী ও নকলার নারায়ণখোলায় গণকবর, শ্রীবরদীর কাকিলাকুড়া গ্রামে রয়েছে বীর বিক্রম শাহ মুতাসীন বিল্লাহ খুররমের সমাধিস্থলসহ জেলার আরও কিছু জায়গায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্তানগুলি নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী ওইসব স্থান সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহন করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী হিমেল রিসিল বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্তে হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছিল। সেখানে আমদের দেশের অনেক মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভারতীয় অংশে তাদের বিএসএফদের স্মরনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করেছে। কিন্তু আমাদের অংশে কোন স্মৃতিস্মম্ভ নেই। আমি শুনেছি যে, সেখানে সীমান্ত এলাকা হওয়ায় ভারতীয়রা বাধা প্রদান করে। তবে সেখানে গিয়ে দেখতে হবে যে প্রকৃত অবস্থাটি কি আছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আক্তারুজ্জামান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর দর্পে যুদ্ধ করে এসব অঞ্চল কে শত্রু মুক্ত করেছে। তারপরেও পাকবাহিনিরা নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপড় সময়ে অসময়ে হামলা চালিয়ে গনহত্যা করেছে। এই স্থানগুলি আমাদের সবারই জানা। এই স্থানগুলি সংরক্ষন করা আমাদের দায়িত্ব।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের গণকবর ও বধ্যভূমিসহ স্মৃতিচিহ্নগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষি। বর্তমান সরকার যখন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ভবন, স্থাপনা, বধ্যভূমি ও স্মারকসমূহ সংরক্ষণে সচেষ্ট, ঠিক তখনও শেরপুরের ওইসব স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না থাকার বিষয়টি দুঃখজনক। তবে আহম্মদনগরসহ জেলার অন্যান্য বধ্যভূমি ও গণকবরের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য ইতো পূর্বে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে ওইসব স্মৃতিচিহ্নগুলো সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের দাবি জানান।