বাঙালির সংস্কৃতি এক এবং অভিন্ন। জাত-পাত আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে পারে না, পারবেও না। মুসলিমেরও বাংলা ভাষা, হিন্দুরও বাংলা ভাষা। আমাদের বর্ণমালা তো একই। এটাকে কেউ কোনদিন ধ্বংস করতে পারবে না। যদি কেউ আমাদের বর্ণমালা ধ্বংস করতে চায় তা কোনদিন সম্ভব হবে না। এটা স্লাগার বিষয়। সোমবার (১৯ ডিসেম্বর ২০২২) সন্ধ্যায় দৈনিক পত্রদূত অফিসে এক সাহিত্য আড্ডায় এভাবেই বলছিলেন কোলকাতার বরেণ্য সাহিত্যিক কাজল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক প্রজন্ম হাজার বছর ধরে বিকাশমান। এই বিকাশ তো একদিনের নয়। বাংলা ভাষার জন্ম প্রাকৃতভাষা থেকে। প্রাকৃত বাংলা নির্ভর যে সভ্যতা তা সহজভাবে চারিত হবে, বয়ে যাবে। প্রাকৃত বাংলা চিহ্নিত হয় ১৪শ’ শতাব্দিতে। প্রাকৃত বাংলা যখন চারিত হবে না তখন এ ভাষা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। কাজেই আমি ওই জায়গাতেই চিন্তিত নই যে, বাংলা ভাষা হারিয়ে যাবে। বাংলা ভাষা হারাবে না। বাংলা ভাষা অমর হয়ে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তরে। যে ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করেছেন আমাদের মধূসূদন দত্ত, জীবনানন্দ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ফকির সে ভাষা কখনো হারিয়ে যেতে পারে না। কাজল চক্রবর্তী বলেন, ধর্মান্ধ হয়ে নয়, বরং সচেতনভাবে আমাদের বাঁচতে হবে। একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর তার গায়ে কোন ধর্মের নাম লেখা থাকে না। আমরাই তাকে ধর্ম চাপিয়ে দিই। মনুষ্য ধর্ম থাকবে। আমাদের মানুষ হিসেবে একে অপরের সাথে মিশে বাঁচতে হবে। সাহিত্যিক কাজল চক্রবর্তী বলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এই সত্যকে ধারণ করতে হবে। সব মানুষের রক্তের রং লাল। তাই আমি মনে করি, ধর্মান্ধ না হয়ে আমরা যদি সচেতনভাবে চলি তাহলে সমাজে-রাষ্ট্রে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত হবেই।
এরআগে পৌষের হিমেল সন্ধ্যায় দুই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি, ভাষা, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। আলোচনায় উঠে আসে শৈশবের দুরন্তপনা স্মৃতি। মায়ের হাতের পিঠা-পুলি, নলেন গুড় আর জিরেন রসের কথা উঠে আসে স্মৃতি রোমন্থনে। উঠে আসে ছেলে-বেলার সেই দুরন্ত দিনের গল্প। দুই বাংলার মানুষের চিরায়ত অভিন্ন সংস্কৃতি চর্চার কথা বলতে গিয়ে কাজল চক্রবর্তী বলেন, ভারতেই ২৯টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। তাই বলে কোন ভাষাই ছোট নয়। সব ভাষার সমান মর্যাদা। ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের দুই বাংলার মানুষকে বেঁধেছে এক ও অভিন্ন বাঁধনে। এ বাঁধন কখনো ছিড়ে যেতে পারে না। সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেন দৈনিক পত্রদূতের উপদেষ্টা সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক লায়লা পারভীন সেঁজুতি, বার্তা সম্পাদক এবং এফএনএস'র বিশেষ প্রতিনিধি এসএম শহীদুল ইসলাম, সহকারী সম্পাদক (সাহিত্য) সৌহার্দ সিরাজ, চিফ রিপোর্টার আবদুস সামাদসহ প্রমুখ।
কাজল চক্রবর্তীর পোশাকী নাম দেবেশ চক্রবর্তী। তাঁর জন্ম ১৯৫৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর কোলকাতায়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার কাজল-এর আটের দশকে লেখালেখির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ শুরু। শুধু কবিতা নয় সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর সম্পাদনায় বিভিন্ন কবি, লেখক, চিত্রকর ও বাচিকশিল্পীদের নিয়ে গবেষণামূলক ‘প্রামাণ্য গ্রন্থ’গুলো গবেষকদের কাজে আসে। ১৯৮১ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন সাংস্কৃতিক খবর সাহিত্যপত্রটি। ১৯৮৭ সাল থেকে আয়োজন করছেন ‘বাংলা কবিতা উৎসব। লেখালেখিকে কেন্দ্র করে কাজল পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, গ্রহণ করেছেন অনেক সাহিত্য পুরস্কার।
মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক কাজলের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৭২। কাজল চক্রবর্তীর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-কবিতা: ঠিক শেই শময় (১৯৮২), অচেনা স্টেশনে (১৯৮৩), চৈত্রের ধুলো উড়ে (১৯৮৪), ভালবাসা, তীব্র ভালবাসা (১৯৮৫), আত্মজ আমার (১৯৮৭), রাঙামাটিতে শেষরাত (১৯৫৬), বিবাহ উৎসব-৮৯ (১৯৮৯), প্রেমে ও পরিক্রমায় (১৯৯০), ভিন্ন রাজ্যপাট (১৯৯১), পদ্যময় মানবজমিন (১৯৯৫), আরেক উৎসবের দিকে (১৯৯৬), কবিতা ৮১-৯৩, (১৯৯৬), নীল রোদের বয়েস (১৯৯৭), অক্ষরজন্ম (১৯৯৮), রোদের খামারবাড়ি (১৯৯৯), বিষাদময় মেয়েদের জন্য (১৯৯৯), পদ্মবছরের অক্ষরমালা (২০০০), পুরুষজীবন (২০০১), শরীরে জড়ানো পাতা (২০০২), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা-১ (২০০২), তোমার সমুদ্রে (২০০০), কবিতা সমগ্র-১ (২০০৩), ছবিতা (২০০৪), পা তুলে দেব চাঁদে (২০০৪), আউল বাউল (২০০৪), আরশিনগর (২০০৪), অনন্ত ঝুমঝুমি (২০০৫), কবিতা সমগ্র-২ (২০০৬), শুনে যেতে পারি (২০০৭), স্বাতীর জন্য ৫০৩ (২০০৮), বিলিয়নকালিন কবিতা (২০০৯), নির্বাচিত প্রেমের কবিতা-২ (২০১০), পুরুষ আমাকে টানো (২০১৪), ফাল্গুনের আগুনে (২০১৫), ভূতবিদ্যা (২০১৫), পুরুষজীবন জুড়ে (২০১১), ফাল্গুনে রচিত (২০১১), কাজল চক্রবর্তীর আবৃত্তিযোগ্য কবিতা (২০২০), কৃপীটযোনি এসো (২০২০), দেহকাব্য (২০২০), শেকড়ছেঁড়া ভালোবাসা (২০২১), স্মৃতিময় কবিতা (২০২১), শ্রুতিনাটক ও আবৃত্তিযোগ্য কবিতা (২০২১), একাই একশো (২০২১), স্বপ্নভুকের কবিতা (২০২১), কাজলের হাইকু (২০২১)। কাব্যনাটক: কাজল চক্রবর্তীর কাব্যনাটক (১৯৯২)। ছড়া: চেনা মুখের ছড়া-১ (২০০৭) চেনা মুখের ছড়া-২ (২০০৮) ভেনিস বাংলা স্কুলের ছড়া-২ (২০২০)। ছোটগল্প: আলীর আযান (২০০৪), হিমান্ত (২০০৫), মৈত্রী সিন্দুর (২০১৫)। ব্যক্তিগত গদ্য: অক্ষরজন্মের ডায়েরি-১ (২০০২)। যুগ্ম কাব্যগ্রন্থ: আগামী (১৯৮৫), কল্প-এ যদি বাঁচি (১৯৮৬), আমাদের সংকেত (১৯৮৯)। রচনা সমগ্র: নির্বাচিত রচনা সমগ্র-এক (২০০৭), দুই (২০০৯), তিন (২০১২), চার (২০১৫), পাঁচ (২০১৯), ছয় (২০২১), কাজল চক্রবর্তীর রচনা সমগ্র (সপ্তম খন্ড)।