নওগাঁর মহাদেবপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়ব্রত পাল রাজশাহী রেঞ্জের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা নির্বাচিত হয়েছেন। ক্লুলেস ডাকাতি মামলার রহস্য উদঘাটনের জন্য এবার তাকে এই সম্মাননা দেয়া হয়। মহাদেবপুরের লিচুতলায় তার অফিস কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি জানান সে ডাকাতি মামলার রহস্য উদঘাটনের কাহিনী।
গত ২৯ অক্টোবর দিবাগত রাত ২টার দিকে উপজেলার মহাদেবপুর-সতিহাট পাকা সড়কের উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের সুলতানপুর মন্ডপের কাছে ১৩/১৪ জনের একদল মুখোশধারী ডাকাত দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গাছের গুল ফেলে পথ রোধ করে। তারা রাজশাহী থেকে আসা ও মহাদেবপুর থেকে যাওয়া কয়েকটি যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস, কার, মোটরসাইকেল, মাছের পিকআপ প্রভৃতি আটকিয়ে যাত্রীদের মারধর করে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, মালামাল, মোবাইলফোন প্রভৃতি লুট করে নিয়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে মহাদেবপুর থানা পুলিশ রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে।
উপজেলা সদরের দুলালপাড়ার মমতাজ হোসেনের ছেলে আবুল কালাম আজাদ এ ব্যাপারে ২ নভেম্বর মহাদেবপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করলে তার মোবাইলের সূত্র ধরে ডাকাতদের আটক করার অভিযানে নামে পুলিশ। সে অভিযান যেন হুবহু সিনেমার এ্যাডভেঞ্চার। অভিযানে নেতৃত্ব দেন মহাদেবপুর-বদলগাছী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়ব্রত পাল। তিনি জানান, নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হকের নির্দেশনায় তিনি মহাদেবপুর থানার ওসি মোজাফ্ফর হোসেন, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ, এসআই শামীনুর রহমান, এসআই জয় দাস, এসআই জাহিদসহ সকল অফিসারদের সমন্বয়ে ৫টি চৌকশ টিম গঠন করে এই ক্লুলেস ডাকাতির রহস্য উদঘাটনে নামেন।
২ নভেম্বর রাতে অভিযানের প্রথমেই তারা বাদী আবুল কালাম আজাদের খোয়া যাওয়া মোবাইলফোন ট্যাগ করেন। সবশেষ উপজেলার চাঁন্দাশ এলাকায় চালু ছিল ওই ফোন। অভিযানের সময় ফোনটি বন্ধ থাকায় সেসময়ের অবস্থান জানা যায়নি। তারা চাঁন্দাশ এলাকায় মোবাইলফোন মেরামতের দুটি দোকানের সন্ধান পান। এরমধ্যে একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান যে, দুদিন আগে তার দোকানে এ্যান্ড্রোয়েড মোবইলফোনের লক খোলার জন্য একজন এসেছিল। রাতেই তার দোকানে গিয়ে খাতায় লেখা ওই মোবাইল নিয়ে আসা ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় তারেক। কিন্তু কোন ঠিকানা বা ফোন নম্বর নেই। এটুকু সূত্র দিয়েই অভিযানের দ্বিতীয় পর্বের যাত্রা শুরু হয়।
কম্পিউটার সফ্টওয়ারে ‘তারেক’ সার্চ দিয়ে মহাদেবপুর উপজেলার অসংখ্য মানুষের নাম পাওয়া যায়। একে একে তাদের ছবি দেখানো হয় মোবাইলফোন মেকারকে। কিন্তু এদের একজনকেও তিনি শনাক্ত করলে পারলেন না। ঘন্টার পর ঘন্টার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর অবশেষে সার্চ দেয়া হয় পাশের মান্দা উপজেলা দিয়ে। এবারও অসংখ্য রেজাল্ট পাওয়া যায়। এদের মধ্যে একজনের ছবি দেখে এটিই সম্ভাব্য মানুষ বলে মনে করেন ওই মেকার। তার বায়োডাটাও মিলে যায়। তার বিরুদ্ধে আগের ডাকাতির মামলাও পাওয়া যায়। অবশেষে তাকে পাকরাওয়ের চেষ্টা।
অভিযানের তৃতীয় ধাপে মহাদেবপুর উপজেলার সীমান্তে মান্দা উপজেলার চকজামদই এলাকা থেকে আটক করা হয় তারেককে। থানায় নিয়ে এসে এবার তার সহযোগীদের নাম জানার চেষ্টা। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী রাতেই পৃথক পৃথক টিম অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় মান্দা উপজেলার মোয়াই থেকে জুয়েল, মহাদেবপুর উপজেলার চককন্দর্পপুর থেকে হায়দার আলী, নিয়ামতপুর উপজেলার ভবানীপুর চকদামনাশপাড়া থেকে সাগর, পরাণপুর হাজীনগর থেকে বিকাশ ও পোরশা উপজেলার সোভাপুর থেকে মেহেদীসহ মোট ৬ ডাকাতকে। এদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে পরের জনের নাম জানতে হয়েছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন এলাকার। একজন শুধু তার পরের জনকে চেনে। সবাই একসাথে সবার পরিচয় জানেনা। এক রাতে তারা যে এ্যাডভেঞ্চার করেছেন ক্লুলেস ডাকাতির রহস্য উদঘাটন করেছেন এজন্যই পুরস্কৃত হয়েছেন জয়ব্রত পাল। তিনি জানান, পোরশা উপজেলায় রাতের অন্ধকারে দুকিলোমিটার হেঁটে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে তাদের।
গত ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজির কার্যালয়ের পদ্মা কনফারেন্স রুমে আয়োজিত পুলিশের বিভাগীয় মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ডিআইজি আবদুল বাতেন বিপিএম অন্যান্যের মধ্যে জয়ব্রত পালকে এমাসের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচিত করেন। পুরস্কারপ্রাপ্ত জয়ব্রত পাল ৩৩ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে যোগদান করেন। এরপর সারদা পুলিশ একাডেমীতে এক বছর ট্রেনিং শেষে ৬ মাস দিনাজপুর জেলায় এবং এরপর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে, নিলফামারী জেলার ডোমার সার্কেলের এএসপি ও টাঙ্গাইল জেলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ট্রাফিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ গত ১৭ অক্টোবর নওগাঁর মহাদেবপুর-বদলগাছী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন।