জলবায়ু পরিবর্তনে বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছা-কয়রা উপজেলার মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে। উপকূলীয় মানুষদের প্রতিনিয়ত প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে। জলবায়ু হচ্ছে কোনো এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়া। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে গ্রিণহাউস প্রভাব বলা হয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন-অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি। যার ফলশ্রুতিতে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়ার মৌসুমি ধারাবাহিকতা বিঘিœত হচ্ছে। এ কারণে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। গত শতাব্দীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ২৩%, নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ১৯% এবং মিথেনের পরিমাণ বেড়েছে ১০০% (আইপিসিসি চতুর্থ প্রতিবেদন ২০০৭)। বেঁচে থাকার জন্য উপকূলী মানুষকে প্রতিনিয়ত নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা বা হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। গত ১৬ বছরে উপকূলীয় উল্লেখযোগ্য ঘূর্ণিঝড়-২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বর সিডর, ২০০৮ সালে ৩ মে নার্গিস, ২০০৯ সালে ২৫ মে আইলা, ২০১৩ সালে ১৬ মে মহাসেন, ২০১৬ সালে ২১ মে রোয়ানু, ২০১৭ সালে ৩০ মে মোরা, ২০১৮ সালে ১১ অক্টোবর তিতলি, ২০১৯ সালে ৩ মে ফণী, ২০১৯ সালে ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালে ২০ মে আম্ফান ও সর্বশেষ ২০২২ সালে ২৫ অক্টোবরে সিত্রাং আঘাত আনে। এ বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূলীয় মানুষের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি করেছে। এ সময় সমুদ্রের লোনাপানি বিভিন্ন বেড়ি বাঁধ ভেঙে লোকালয়সহ ফসলের মাঠে প্রবেশ করছে। আর এ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষের বসবাসে দুর্বীষ হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লোনাপানির আধিক। আর নষ্ট হয়েছে সুয়েপ পানি। উপকূলীয় উপজেলা পাইকগাছা-কয়রায় লবণাক্ততায় মাটির অনুর্বরতা হয়েছে। প্রতিনিয়ত নদ-নদীর বাঁধ ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল (বঙ্গোপসারের মুখোমুখি) দেশের অন্যতম দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। জলবায়ু প্রভাবের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ এলাকার বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তে হাজার হাজার মানুষ অভিবাসন হচ্ছে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর হচ্ছে। বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠী বা মানুষের গ্রাম থেকে শহরে আগমন, স্থান বদল, কয়েকদিন কিংবা বহু বছর নিজের আদি বা স্থায়ী বাড়ি থেকে অনুপস্থিতি, সাময়িক অভিবাসন বা স্থায়ী আবাস পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুকরণ ও ক্ষমতায়নে খুলনা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় পাইকগাছা, কয়রা সহ মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ২০১৮ সাল থেকে এনজিও ডরপ পানিই জীবন প্রকল্প কাজ করছে। প্রকল্পের পাইকগাছায় বাজেট মনিটরিং ক্লাবের সহ-সভাপতি অ্যাড. এফএমএ রাজ্জাক এফএনএসকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা একান্ত প্রয়োজন। সে ক্ষেতে অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি ডরপ’র পানিই জীবন প্রকল্প অগ্রণীয় ভূমিকা রাখছেন। ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্যা রুরাল পূয়র (ডরপ) পানিই জীবন প্রকল্প উপজেলা সমন্বয়কারী মো. আবু সায়েম হোসেন এফএনএসকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির জন্য নীতি নির্ধারকদের সাথে এডভোকেসি, ইউপিতে বাজেট প্রণয়নে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে ডরপ পানিই জীবন প্রকল্প। ইতোমধ্যে পাইকগাছা, কয়রা ও মোরেলগঞ্জ এ ৩ উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়নে প্রকল্প থেকে ৫৫টি আর এ্যাডভোকেসী করে আরো ৩০টি পিএসএফ মেরামত, প্রকল্প থেকে হতঃদরিদ্র পরিবারে ১৩১১টি ও এ্যাডভোকেসী করে আরো ১১০০টি প্লাষ্টিক ট্যাংক স্থাপন, প্রকল্প থেকে ৪৫াট এটাস্ট অপসেট টয়লেট স্থাপন এবং এ্যাডভোকেসী করে হতঃদরিদ্র পরিবারে ২৮৫টি অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। পাইকগাছা নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাড. প্রশান্ত মন্ডল এফএনএসকে বলেন, জলবায়ুর এ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিশেষ করে বিভিন্ন অভিযোজন কলাকৌঁশল রপ্ত করতে হবে, যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা মানুষের ঝুঁকি কমানো যায়। জলবায়ুর পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে ভাঙা গড়ার এ ভারসাম্য আরও প্রকট হবে।