সরকারী বিশেষ বরাদ্দে নদী ভাঙ্গন রোধের জরুরি কাজ দুই মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয়নি ৮ মাসেও। একদিনের জন্যও প্রকল্প এলাকায় আসেননি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। যে টুকু জিও ব্যাগ ভরানো হয়েছে তার মুজুরি দিচ্ছেন প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপণ্ডসহকারী প্রকৌশলী নিজেই। নিম্ন মানের ব্যাগ আর ডাম্পিং পয়েন্ট খুড়ে কাঁদা-বালুর মিশ্রণে ভরা হচ্ছে বস্তা।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় জিও ব্যাগ ডাম্পিংএর অস্তিত্ব না থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ভাষ্য-প্রায় ১০ হাজার ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী নদী শাসনে সরকারী এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছে-‘হরিলুট বাজেট’।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুরের প্রকল্প এলাকা কারেন্টবাজার ও মন্ডলের হাট ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড।
প্রকল্প টেন্ডার নোটিশ থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের এ কাজটি গত বছরের ১২ মে শুরু হয়ে শেষ হওয়ার কথা ২৯ ডিসেম্বর। কিন্তু ঠিকাদার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকায় মেয়াদ শেষ হলেও শুরু হয়নি ডাম্পিং কাজ।
হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মঞ্জরুল হক মঞ্জু বলেন, নদী ভাঙ্গন রোধে টেকসই কাজের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শুরু থেকেই আমরা কাজে গলদ দেখতে পাঁচ্ছি। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড নয়-ছয় বুঝিয়ে, কাজ না করে লুটপাট করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, শুনতে পেলাম কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ডিসেম্বরে অথচ এখনও কাজ শুরু হলো না। কাজ না করেই বস্তা ডাম্পিং দেখানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কাজ না করার পায়তারা হচ্ছে। আবাদি জমিতে বালু ফেলে বস্তা ভরাটের কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক বলতে গেলেই গালিগালাজ ও মামলার হুমকি দিচ্ছেন উপণ্ডসহকারী প্রকৌশলী (এসও) নজরুল ইসলাম। আমি বিষয়গুলো স্থানীয় এমপিকে জানিয়েছি। কাজ সঠিকভাবে না হলে প্রয়োজনে দলীয় ফোরামে আলোচনা করব।
প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা খয়বার সরদার (৭০) বলেন, প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপণ্ডসহকারী প্রকৌশলী (এসও) নজরুল ইসলাম নিজেই জিও ব্যাগ ভরানোর কাজ করছেন। অনেক খারাপ বস্তা যেগুলো বালু তোলার পর ছিড়ে যাচ্ছে। আমরা বলতে গেলে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করেন। কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন তিনি। প্রশ্ন রেখে খয়বার সরদার আরো বলেন, প্রকল্প অফিসারের কাজ কি? তার তো শতভাগ কাজ ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু এখানে কোন ঠিকাদার নেই। তার কোন লোক নেই। তিনি ভালোমন্দ যাচাই করবেন তিনিই ঠিকাদারের হয়ে কাজ করছেন। আমরা এই কাজটি সুষ্ঠুভাবে হওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
নদী ভাঙ্গন এলাকার আরেক বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার একটি গ্রাম গত জুলাই মাসে তীব্র ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। এই কাজ যথাসময়ে শুরু করলে গ্রামটি রক্ষা পেত। এখন যে জায়গায় কাজ হচ্ছে সেটি আবাদি জমি। পাশেই ভাঙ্গনের মুখে লোকালয়। এখানে কাজ করে সরকারের ও এলাকাবাসীর কি উপকার হবে জানা নেই। কাজটি আমরা লোকালয় রক্ষার জন্য করতে জোর দাবি জানাচ্ছি।
কারেন্ট বাজার এলাকা ঘুরে জানা যায়, জরুরি ভাঙ্গন রোধে এলাকাটির জন্য সাড়ে ছয় কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু ৮ মাসেও কাজ শুরু করতে পারেনি কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড। মুল ঠিকাদার একদিনও এলাকায় আসেননি। মিলন প্রফেসর নামের একজন ব্যক্তি কয়েক হাজার বস্তা বালু ভরে নদীর কিনারে রেখেছেন। মাঝে মাঝে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন আসেন। দেখে যান, কিন্তু কাজের অগ্রগতি বিষয়ে কিছু বলেন না।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানা গেছে-কাজটি রংপুরের ঠিকাদার আসিবুল হাসান সুজনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে হলেও তিনি কাজটি করছেন না। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুড়িগ্রাম অফিস সরাসরি কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন। সাথে রয়েছেন স্থানীয় এমপি শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি তার বিশ্বস্থ সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক সরদার মিজানুর রহমান মিলনকে দিয়ে প্রকল্প তদারকি করছেন।
এদিকে কাজ শুরু হতে না হতেই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে এমপির লোক মিলনের সঙ্গে হরিপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। জিও ব্যাগের নদীতে ফেলা শুরু না হতেই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে তাদের। বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি মিলনের বাসায় চ’ড়ান্ত বৈঠক করেছেন হরিপুর ইউনিয়ন জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান ফরিশ। সমঝোতা না হওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে। যে এলাকাটি রক্ষায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল-কর্তৃপক্ষের উদাসিনতা, কাজ নিয়ে এমপির লোকদের মধ্যে দ্বন্দ্বে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে নতুন করে হুমকির মুখে পড়েছে মাত্র আধা কিলোমিটার দুরে নির্মাণাধীন সাড়ে সাতশ কোটি টাকা ব্যয়ে চিলমারী-হরিপুর তিস্তা ব্রিজ প্রকল্প।