কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান রিচার্লিসনের সেই গোলটি এখনও চোখে লেগে আছে। সারবিয়ার বিপক্ষে ভিনিসিয়ুসের বক্সে ঠেলে দেওয়া বলে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে শরীর বাঁকিয়ে শূন্যে উঠে যেভাবে বাইসাইকেল কিকে জাল কাঁপালেন, তা ছিল অনিনদ্য সুন্দর। বাংলাদেশের প্রিমিয়ার লিগে অনেকটা একই ধরনেরই গোল করেছেন তারই স্বদেশি দোরিয়েলতন। রাকিব হোসেনের দুর্দান্ত মাপা ক্রসে বাইসাইকেল কিকে গোলের ঠিকানায় বল পাঠিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। ঢাকার মাঠে এমন লক্ষ্যভেদ দেখে তাই অনেকের আফসোস করছেন, স্থানীয় খেলোয়াড়দের পায়ে কবে এমনটি দেখা যাবে? ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের তুলনা যায় না। তবে অনেক দিন ধরেই স্থানীয়দের সঙ্গে ভালো মানের বিদেশিরা খেলছেন। তাদের সঙ্গে খেলে শেখার আছে অনেক কিছুই। কিন্তু আদৌ কি সবাই তা শিখতে পারছেন? আর শিখে মাঠে তা কতটুকু প্রয়োগ করতে পারছেন। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে নানান সীমাবদ্ধতা সামনে চলে এসেছে। সাবেক তারকা ফুটলার আশরাফ উদ্দিন চুন্নু যেমন উদাহরণ টেনে বলেছেন,আমরা পারি না। কারণ হলো আমাদের কোয়ালিটি ফুটবলারের অভাব। যারা করছেন, তারা হাইপ্রোফাইল বিদেশি খেলোয়াড়। আমাদের সময় অনেক কোয়ালিটি খেলোয়াড় ছিল বলেই ফুটবল জনপ্রিয় ছিল। অনেকে ব্যাক ভলি হেড কিংবা নানানভাবে গোল করে দর্শকদের আনন্দ দিতো। মনের কোঠায় স্মৃতিটা ঢুকে পড়তো, এখন তো তা নেই।’ মেসি-এমবাপ্পেদের উদাহরণ টেনে চুন্নু বলছিলেন,এছাড়া কিছু কিছু আছে ঈশ্বর প্রদত্ত মেধার খেলোয়াড়, এই যেমন মেসি-এমবাপ্পে। এখন আমাদের যদি কোয়ালিটি ফুটবলার থাকতো তাদের মধ্যে ঘষা-মাজা করে এগিয়ে নেওয়া যেতো। তখন ভালো কিছু শটও আমরা দেখতে পেতাম, এই মুহূর্তে তা নেই। এই সময়ে মানসম্মত ফুটবলারের বেশ অভাব। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আসবে।’ বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে যে একদমই চোখ ধাঁধানো গোল নেই, তা কিন্তু নয়। এই তো কয়েক বছর আগে মতিন মিয়ার মধ্য মাঠ থেকে কয়েকজনকে কাটিয়ে গোলটি এখনও মনে ধরে আছে। কিংবা গত মৌসুমে মোরছালিনের প্রায় ৪০ গজ দূর থেকে নেওয়া বুলেট গতির শটে করা গোলটি তো দুর্দান্ত ছিল। তবে সচারচর এমন গোল না হওয়ার পেছনে যুক্তি তুলে ধরেছেন জাতীয় দলের বর্তমান স্ট্রাইকার সুমন রেজা। বলার চেষ্টা করেছেন এভাবে,চেষ্টা আমরাও করি। অনুশীলনে কিছু শট নিয়েছিলাম। কিন্তু ঠিকঠাক হয়নি। ওর (দোরিয়েলতন) মতো পারফেকশন আসে না। আমরা সেভাবে শট নিতে ভয়ও পাই। আমরাও অবাক হয়েছি এমন (দোরিয়েলতের) পারফেকশন কীভাবে হয়। ওর কাছ থেকে আমরা শিখছি। ও হয়তো অনেক পরিশ্রম করে এই জায়গায় এসেছে।’ এরপর সহজ-সরল বাক্যে পরিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরলেন এই তারকা,আসলে আমরা সিম্পল ফুটবল খেলতে চাই। ফুটবলে যে সৌন্দর্য আছে সেদিকে যাই না। আমরা হলে হয়তো বলটা (দোরিয়েলতনের গোলটা) হেড কিংবা প্লেসিং করতাম। ঝুঁকি নিতে চাই না আসলে আমরা।’ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের ফুটবলে কোচিং করছেন মারিও লেমস। আবাহনী লিমিটেডের এই পর্তুগিজ কোচ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে অন্তরায় খুঁজে পেয়েছেন,ফুটবলে এগিয়ে থাকা দেশগুলোতে ৭ থেকে ৮ বছর বয়সীদের নিয়ে ভবিষ্যতের ফুটবলার হিসেবে গড়ে তোলা হয়। রাফায়েল কিংবা দোরিয়েলতনরা ফ্লমিনেসের মতো একাডেমিতে দীক্ষা পেয়েছে। দোরিয়েলতন যে বাইসাইকেল গোল করেছে তা তার অনেক সাধনার ফসল। এর জন্য ওকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার মনে হয় বাংলাদেশের এমন কারও শটে গোল করতে হলে সেভাবেই গড়ে আসতে হবে।’ এরপর আশাবাদী কণ্ঠে বলেছেন,তবে এখানে তো একাডেমির চর্চাটা সেভাবে নেই। ছোটবেলা থেকে যে গড়ে উঠবে সেই সুযোগ কম। আমার দেখা গত ৫ কিংবা ৬ বছরে স্থানীয় খেলোয়াড়দের এমন শট কমই নিতে দেখেছি। তাদের পক্ষে নেওয়া কঠিনও। তবে আগের চেয়ে এই দেশের ফুটবলের চিত্র একটু একটু করে বদলাতে শুরু করেছে। হয়তো সামনের দিকে আমরা আরও কোয়ালিটি ফুটবলার পাবো যাদের পায়ে দারুণ কিছু মুভ কিংবা শট দেখতে পারি।’