বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের তীর্থভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে ও বিজয়ের শেষ প্রান্তে আশুগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ স্মৃতিকে অমলিন করে রাখতে ঢাকাণ্ডসিলেট মহাসড়কের পাশের্^ আশুগঞ্জ গোলচত্ত্বর এলাকায় গড়ে তোলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্তম্ভ। কিন্তু, একটি স্বার্থান্বেসী মহল মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের এই স্মৃতি স্তম্ভটি অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দখল করে নিচ্ছে। স্মৃতি স্তম্ভের দেয়াল ভেঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে পাকা দোকান ঘর। স্মৃতি স্তম্ভের মূল অবকাঠামোকে পিছনে ফেলে এমন অবৈধ দখলের কারণে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে।
সংক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা জানান, উপজেলার চরচারতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান ও ছয়জন মেম্বারের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ গোলচত্ত্বর অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্তম্ভ দখল করে পাকা দোকান ঘর নির্মাণ করছেন। ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে স্মৃতি স্তম্ভের নিরাপত্তা দেয়াল। স্মৃতি স্তম্ভের মূল অবকাঠামোকে পিছনে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে পাকা দোকান ঘর। অথচ এ বিষয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বা স্থানীয় কোন মুক্তিযোদ্ধাই ওয়াকিবহাল নন। একটি চক্র নিছক নিজেদের স্বার্থে এমন অপকর্ম করছে বলে তাদের দাবি।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর ফোরাম আশুগঞ্জ উপজেলার সারাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুল করিম বলেন, মহান বিজয়ের ঊষালগ্নে ৯ ডিসেম্বর আশুগঞ্জে ভারতীয় মিত্রবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানি শত্রু বাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ১০ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল। এই যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মিত্রবাহিনীর সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি আশুগঞ্জবাসী এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে। সেই স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বাজেটে বহু বছর আগে সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্তম্ভ বানিয়েছি। প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ উপজেলাবাসী স্মুতি স্তম্ভ চত্ত্বরে আশুগঞ্জ মুক্ত দিবস পালন করে। কিন্তু কতিপয় স্বার্থন্বেসী মহল তা দখল করে বাণিজ্য করবে তা মুক্তিযোদ্ধারা মেনে নেবে না।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জাহাঙ্গীর খন্দকার বলেন, “ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ কেউ দখল করবে এটা দেখব কখনো ভাবিনি। এসব দেখার আগে মরে যাওয়া ভাল ছিল। এজন্য যুদ্ধ করিনি। শেষ ইজ্জতটুকুও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক আর কোন কাজ হতে পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্তম্ভ দখল করছে তাদের ধিক্কার জানাই। অতি বিলম্বে দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিচারের আওতায় আনার দাবি করছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শেষ ইজ্জতটুকু নিয়ে মরতে চাই।“
সরেজমিনে মুক্তিযদ্ধের সম্মুখ সমরের স্মৃতি স্তম্ভে গিয়ে দেখা যায় এর দেয়াল ভেঙ্গে দ্রুত দোকান নির্মাণ কাজ চলছে। স্মৃতি স্তম্ভটির সামনেই রাখা হয়েছে ইট, বালু ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী। এ সময় চরচারতলা ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আবুল কালামকে দোকান নির্মাণ কাজ তদারকি করতে দেখা যায়। তিনি জানান, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়নে দোকান ও কফি সপ করা হবে। আমাদের সাথে দুজন মুক্তিযোদ্ধাও পার্টনার রয়েছে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জাহাঙ্গীর খন্দকার ও মোঃ আব্দুল করিমসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়নের বিষয়টি একটি প্রতারণা। এ ব্যাপারে কোন মুক্তিযোদ্ধার সাথে পরামর্শ হয়নি। আমরা সরকারি জায়গায় স্মৃতি স্মম্ভের অনুমতি নিয়েছি। এখানে কাউকে ব্যবসার অনুমতি দেয়া হয়নি। দখলদাররা সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে জাতিকে অপমান করে তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। আমাদের কোন সহ-যোদ্ধার কাঁধে ভর করে থাকলেও তা হবে জাতির সাথে ও শহীদের সাথে বেইমানি। এই বিষয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও আশুগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার অরবিন্দ বিশ্বাস জানান, বিষয়টি আমি এই মাত্র জানতে পারলাম। দ্রুতই দখলদারদের উচ্ছেদ ও কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এ বিষয়ে চরচারতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে জানা যায় তিনি চিকিৎসা জনিত কারণে ভারতে রয়েছেন। তার হুয়ার্টসঅ্যাপ এ কল দিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।