দেশ থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রত্নসম্পদ। প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রাচীন মুদ্রা, শিলালিপি, স্থাপনার অংশ, পুঁথি, তৈজসপত্র, অলংকারসহ মূল্যবান অনেক প্রত্নসম্পদ পাঁচার হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রগুলো থেকেও অনেক নিদর্শন চুরি হয়ে যাচ্ছে। আর ওসব নিদর্শনের বড় একটি অংশ স্থানীয় বাজারেই কেনাবেচা হচ্ছে। আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেশের ধনাঢ্য অনেক ব্যক্তি ওসব সম্পদ ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখছে। প্রতি বছর যে পরিমাণ প্রত্নসম্পদ পাঁচার বা চুরি হয় তার তুলনায় উদ্ধার হয় খুবই কম। বছরে অন্তত কয়েকশ কোটি টাকার প্রত্নসম্পদ চুরি বা পাঁচার হচ্ছে। এমনকি ওই অর্থ হাজার কোটি টাকার বেশিও হতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রত্নতত্ত্ববিদদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) গত ১ নভেম্বর রাজশাহী সীমান্ত থেকে পাঁচারের সময় ১০২ কেজি ওজনের কালোপাথরের একটি মূল্যবান বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার করে। তার ২দিন আগে ৩০ অক্টোবর নীলফামারী সীমান্ত থেকে এমন আরেকটি মূর্তি উদ্ধার হয়। বিগত ২০২২ সালে পাঁচারের সময় বিজিবি এমন মোট ৩১টি মূল্যবান কালোপাথরের মূর্তি উদ্ধার করেছে। সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও বিপুল পরিমাণ প্রত্নসম্পদ উদ্ধার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে অ্যান্টিক শপের আড়ালে প্রত্নসম্পদ পাঁচার করতে গিয়ে ধরা পড়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তথ্যানুযায়ী গত এক যুগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুধু র্যাবই কয়েক শতাধিক প্রত্নসম্পদ উদ্ধার করেছে।
সূত্র জানায়, বাংলার প্রাচীন জনপদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রগুলো কয়েক হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এখানে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী ও অত্যন্ত সমৃদ্ধ জনপদণ্ডনগর গড়ে উঠেছিল। সেগুলো এখন কালের বিবর্তনে ভূগর্ভে বিলীন হয়েছে। দীর্ঘসময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইমারত, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার, স্তূপ ও সমাধিসৌধ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেগুলোর কোনো কোনোটিকে শনাক্তের পর খনন কার্যক্রম চালিয়ে লুকোনো ইতিহাসকে বের করে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু প্রত্নসম্পদ পাঁচার ও চুরি প্রত্নতাত্ত্বিকদের মাঠ পর্যায়ের কাজ চালানোর পথেও বড় বাধা হয়ে উঠেছে। অনেক সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের আগেই স্থানীয় অধিবাসী ও দুর্বৃত্তরা প্রত্নসম্পদের সন্ধান পেয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে মূল্যবান সম্পদ ও নিদর্শন তুলে পাঁচার করা হচ্ছে। আবার প্রত্নকেন্দ্র আবিষ্কার ও খননের পর যথাযথ নজরদারি ও পাহারার অভাবের সুযোগেও অনেক সম্পদ চুরি হয়ে যাচ্ছে। এমনকি খোদ জাতীয় জাদুঘর থেকেও প্রত্নসম্পদ চুরি বা খোয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১০ সালে জাতীয় জাদুঘর থেকেই ২৬টি মূল্যবান প্রত্নসম্পদ খোয়া যায়। আর ২০১৮ সালের আগস্টে রাজধানী থেকে পাঁচারের সময় ৩২টি প্রত্নসম্পদ আটক করা হয়। আর কভিড মহামারী চলাকালেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে পাঁচারের সময়ে বেশকিছু প্রত্নসম্পদ আটক হয়। অবশ্য মহামারীর বছরটিতে গোটা বিশ্বেই প্রত্নসম্পদ চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। প্রত্ন বা শিল্পসম্পদের ক্রেতাদের বড় একটি অংশ সাধারণত নিলামের মাধ্যমে ওই ধরনের বস্তু হস্তগত করেন। প্রকাশ্য নিলামে নিরাপদে বৈধভাবে প্রত্নসম্পদগুলোকে উপস্থাপন করতে তার আগে কয়েক দফায় বেচাকেনা করা হয়। আবার এ সম্পদ হস্তগত করার পর তা হয়ে ওঠে অবৈধ অর্থকে বৈধ করার হাতিয়ার। সেক্ষেত্রেও কয়েক দফা কেনাবেচার মাধ্যমে কালো টাকাকে আড়াল করা হয়ে থাকে। এই সুযোগ নিয়ে কালো টাকা সাদা করার পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাঁচার হচ্ছে। আবার প্রত্ন ও শিল্পসম্পদের নিলামগুলোয় ক্রেতার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্ত থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে এ-সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করে আনতেও হিমশিম খেতে হয়।
এদিকে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, শুধু চুরি বা পাঁচার নয়, অনেক সময়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অবহেলা বা স্থানীয়দের অজ্ঞতাবশতও অনেক প্রত্নসম্পদ নষ্ট হচ্ছে। এমনকি প্রত্নকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত স্থানের মধ্যখান দিয়ে সড়ক নির্মাণেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। আবার অনেক স্থানে প্রাচীন স্থাপনার ইট খুলে নিয়ে রাস্তা নির্মাণ বা স্থানীয়দের বাড়িঘর নির্মাণের কথাও শুনতে পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেক সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারাও প্রত্নসম্পদের কথা প্রকাশ করতে চান না। মূলত ব্রিটিশ আমলে করা সংশ্লিষ্ট আইনটি যুগোপযোগী না হওয়ার কারণেই এমন ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ওই আইনে পরিবর্তন আনতে হবে।