আত্মহত্যার প্রবণতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করছে। মানে প্রতিদিন ৩০ জনেরও বেশি। আত্মহত্যার বৈশ্বিক হারের (প্রতি লাখে ১০ জন) তুলনায় বাংলাদেশের আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে কম (প্রতি লাখে ৬.৫ জনের বেশি)। তবে বাংলাদেশের সব আত্মহত্যার খবর সংবাদ মাধ্যমের কাছে পৌঁছায় না, তাই প্রকৃত সংখ্যা হতে পারে এর চেয়ে অনেক বেশি। এ আত্মহত্যার অধিক সংখ্যকই নারী। কিন্তু ঠিক কি কারণে হাজার হাজার নারী এভাবে জীবন শেষ করে দিচ্ছে, তাদের সেই সূত্র ধরে ক্ষতিয়ে দেখলে যানা যায়, বখাটের অত্যাচার, ধর্ষণ, দাম্পত্য, কলহ, বিচ্ছেদ, প্রেম, দরিদ্রতা, ঋণ উল্লেখযোগ্য।
তাছাড়া, শ্বশুরবাড়িতে অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণেও বৈবাহিক জীবন নিপীড়নমূলক এবং শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠতে পারে। নারীরা সত্যিই সহনশীল; তবে সহ্যেরও সীমা থাকে।’ ‘বেশির ভাগ মেয়েরই ১৮ বছর হতে না হতেই বিয়ে হয়ে যায়। তারা তখন হয়ে ওঠে কারো স্ত্রী এবং পুত্রবধূ। অল্প বয়সে সংসারের দায়িত্ব নিতে পারে না অনেকেই। এছাড়া, তাদের চলাফেরার ওপরও বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থাকে না বললেই চলে। নির্যাতনের শিকার হতে হতে হতাশা তাদেরকে গ্রাস করে।’ ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নারীদের অনেকেই হয়তো তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। কেউ কেউ আবার আত্মহত্যাকে এক বিশেষ রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আত্মহননকারী রেখে যান সুইসাইড নোট। কিংবা রোগের জ্বালা সইতে না পেরে চলে যাচ্ছি। নানা সুইসাইড নোটে নানান কথা। আবার সবাই যে সুইসাইড নোট রেখে যায় তাও নয়। কোনো কোন ক্ষেত্রে কারণ জানাই যায় না, অনুমান করা হয় অনেক কিছু। তবে বয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ আলাদা হয় বলে যানা যায়। ‘সন্তানরা বড় হয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর অনেকেই শূন্যতা বোধ করেন, যাকে ‘এম্পটি নেস্ট সিন্ড্রোম’ বলা হয়। আবার অনেকে বিষন্নতা ও হতাশায় ভোগেন। কেউ বা ছেলে, মেয়ে, স্বামী, পুত্রবধূর সাথে রাগ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এমনই নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই আমাদের দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে।
আত্মহত্যা প্রবণ মানুষদের জীবনের মূলস্রােতে ফিরিয়ে আনতে যে সামাজিক ব্যবস্থা দরকার তা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। বিভিন্ন রকম মানসিক অসুস্থতা ও আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়, তার চিকিৎসা ব্যবস্থাও বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় খুবি কম। তাই এ প্রবণতার উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। অন্যথায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। তবে যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর সে জন্য প্রধান কাজ হলো একটি ‘জাতীয় আত্মহত্যা প্রতিরোধ কৌশলপত্র’ গুরুত্ব সহকারে প্রণয়ন করা। যেমন-আত্মহত্যায় ব্যবহৃত উপকরণগুলোর প্রাপ্যতা কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা, সু-নজরদারির মাধ্যমে প্রতিরোধের ব্যবস্থা (বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা, (এরই মধ্যে এটি সরকারিভাবে শুরু হয়েছে), আত্মহত্যার ঝুঁকি বিষয়ে সচেতনতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা হ্রাসের দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ, ই-স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যাপ্ত মনো-চিকিৎসকের ব্যবস্থা করা, আত্মহত্যা সম্পর্কিত বিবেচনাপ্রসূত সংবাদ পরিবেশন, কাউন্সেলিংয়ের জন্য হটলাইন সার্ভিস চালু ইত্যাদি। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন ও মোবাইল আসক্তি দূর করতে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা, শরীর চর্চা, খেলাধুলা, নিজ নিজ ধর্ম চর্চা, আত্মোউন্নয়ন ও ধ্যানের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বেঁচে যেতে পারে লাখো প্রাণ।