বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ঐতিহাসিক প্রতীক শহীদ মিনার। অথচ বরিশালের সদর উপজেলাসহ দশটি উপজেলার ৭৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১১টিতেই নেই শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর আর স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে পারছে না। এমনকি দিবসটি যথাযথভাবে তারা পালনও করতে পারছে না। এরমধ্যে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাঠ-বাঁশ ও কাগজ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। এনিয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, ভাষা সৈনিকদের পরিবারসহ সচেতন মহলে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের দাবি দ্রুত সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হোক। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে (একুশে ফেব্রুয়ারি) নানা কর্মসূচি পালনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকারের নানা নির্দেশনা থাকে। কিন্তু যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে এর ব্যত্যয় ঘটে। শহীদ মিনার না থাকার অজুহাতে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দিবসটিতে ছুটি ভোগ করে থাকেন। জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৭৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরমধ্যে ৩১১টিতে শহীদ মিনার নেই। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদ্রাসার সংখ্যাই বেশি। সূত্রমতে, বরিশাল সদর উপজেলায় ২২টি কলেজের মধ্যে তিনটিতে, ৯৩টি স্কুলের মধ্যে ২৩টিতে এবং ৩৭টি মাদ্রাসার মধ্যে নয়টিতে শহীদ মিনার নেই। মুলাদী উপজেলার সাতটি কলেজের মধ্যে একটিতে, ৩৯টি স্কুলের মধ্যে পাঁচটিতে এবং ২০টি মাদ্রাসার মধ্যে একটিতেও শহীদ মিনার নেই। উজিরপুর উপজেলার ১২টি কলেজের মধ্যে চারটিতে, ৫১টি স্কুলের চারটিতে এবং ২১টি মাদ্রাসার মধ্যে সাতটিতে শহীদ মিনার নেই। বানারীপাড়ায় সাতটি কলেজের মধ্যে দুইটিতে, ৩৫টি স্কুলের মধ্যে দুইটিতে এবং ১৮টি মাদ্রাসার মধ্যে একটিতেও শহীদ মিনার নেই। গৌরনদী উপজেলার ছয়টি কলেজের সবগুলো এবং ২৭টি স্কুলের সবগুলোতে শহীদ মিনার থাকলেও ১৪টি মাদ্রাসার মধ্যে ১০টিতে শহীদ মিনার নেই। ওই উপজেলার শতবর্ষী গেরাকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজো নির্মিত হয়নি কোন শহীদ মিনার। ফলে এবারও দিবসটি পালন করতে পারেনি ওই বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। আগৈলঝাড়া উপজেলার দুটি কলেজের মধ্যে একটিতে, ৩৪টি স্কুলের মধ্যে ছয়টিতে এবং ছয়টি মাদ্রাসার একটিতেও শহীদ মিনার নেই। বাকেরগঞ্জ উপজেলার ২৪টি কলেজের মধ্যে ১০টিতে, ৮৪টি স্কুলের মধ্যে ১৫টিতে এবং ৬৩টি মাদ্রাসার একটিতেও শহীদ মিনার নেই। বাবুগঞ্জে চারটি কলেজের মধ্যে দুইটিতে, ৬৩টি স্কুলের মধ্যে ১৪টিতে এবং ১৮টি মাদ্রাসার মধ্যে একটিতেও শহীদ মিনার নেই। মেহেন্দিগঞ্জে ছয়টি কলেজের মধ্যে একটিতে, ৬৩টি স্কুলের ১০টিতে এবং ২৭টি মাদ্রাসার মধ্যে ২৫টিতে শহীদ মিনার নেই। হিজলা উপজেলায় দুইটি কলেজের মধ্যে একটিতে, ২৭টি স্কুলের মধ্যে তিনটিতে, নয়টি মাদ্রাসার মধ্যে একটিতেও শহীদ মিনার নেই।
বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, ভাষা আন্দোলন ৭১ বছরে পা রাখলেও বরিশালের ৩১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত প্রজন্মের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারছেন না। যেকারণে ভাষাসৈনিকদের অবদান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা ’৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব সম্পর্কেও সঠিক ধারণা নিতে পারছে না। তাই খুব শীঘ্রই সংশ্লিষ্টদের ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বরিশাল নগরীর বাসিন্দা ভাষাসৈনিক মরহুম একেএম আজাহার উদ্দীনের ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দিক সোহেল বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যতিত বিশ্বের আর কোথাও মায়ের ভাষার জন্য যুদ্ধ হয়নি। তাইতো মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, শহীদ মিনার আমাদের ইতিহাস ও অর্জনের অন্যতম স্তম্ভ। তাই সরকারি ও বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা উচিত। বরিশাল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শহীদ মিনার আমাদের চেতনার জায়গা। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শহীদ মিনার হবে। কারণ এটি আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি এ জেলার সদ্য যোগদান করেছি। তাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে শহীদ মিনার নেই, এমন তথ্য আমার জানা ছিলোনা। বিষয়টির খোঁজ খবর নিয়ে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।