প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা,
আজকের এই সংবাদ সম্বেলনে আমার আহ্বানে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য আপনাদের প্রতি আমি কতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং আপনাদের সক্রিয় সহকর্মী। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকার প্রয়োজনে ছাত্রাবস্থায় আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মো. আবদুল হামিদ মহোদয়ের নেতৃতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। স্বাধীনতার পর ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি পদে দায়িত্বরত আছি। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, প্রায় ৪০ বছর যাবৎ ঢাকায় বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্রে একজন সংবাদকর্মি হিসেবে কাজ করে আসছি। আজ আমি বয়সের ভারে ন্যূব্জ এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য বলতে গেলে চলৎশক্তিহীন।
এমতাবস্থায় আজকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সংকটাপন্ন অবস্থায় আপনাদের সামনে দল এবং দেশের স্বার্থে কিছু কথা এবং একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার অবস্থান তুলে ধরার জন্য আজকের এ সংবাদ সম্মেলন।
প্রিয় বন্ধুরা, আপনারা জানেন ১৯৮৩ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার এদেশের সনাতন ধর্মীয় লোকদের স্বার্থে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান আইনের মাধ্যমে গড়ে তোলেন। ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন এ প্রতিষ্ঠানের বিধান অনুযায়ী একটি ২১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড-এর মাধ্যমে এর কার্যক্রম চলে আসছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এদেশের সনাতন ধর্মীয় নেতাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আজকের দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অসীম উদারতায় এই ট্রাস্টি বোর্ড আইন পরিবর্তন করে একটি কার্যকরী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠন করেন, যার মেয়াদ ৩ (তিন) বছর এবং বিগত ১৩ জানুয়ারি, ২০২৩ যে বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দয়াপরবশ হয়ে একজন মক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমাকে ঐ বোর্ডের একজন ট্রাস্টি নিযুক্ত করেছিলেন। তৎকালীন বোর্ডে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন শ্রী সুব্রত পাল, যিনি বোর্ডের সকল সদস্যদের তুলনায় বয়োকনিষ্ঠ, তথাপি ওনার আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী বোর্ডের কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। আপনারা জানেন, বিগত দু’টি বছর কোভিড-১৯-এর জন্য সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও সকল কার্যক্রমে ব্যাহত হয়েছে। তথাপি আমরা আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত পালের আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, বিদেশে অর্থ পাঁচার, এবং দুদক আইনে তার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান মাননীয় ধর্ম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সচিব মহোদয়ের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায়নি। উপরন্তু সদ্যঘোষিত হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে শ্রী সুব্রত পালের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। দেশে সনাতন সমাজে এত জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ থাকতে প্রশ্নবিদ্ধ শ্রী সুব্রত পাল পর পর তিনবার তিন মেয়াদে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে কীভাবে বহাল থাকেন, জাতি এর রহস্য জানতে চায়।
আপনাদের অবগতির জন্য আমি কিছু তথ্য উপস্থাপন করছিÑ যেগুলো যে কোনও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তদন্ত করলে যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আমি হলফ করছি।
১। দুর্নীতির দায়ে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত পালের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা চলমান;
২। ট্রাস্টের বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) চাপ প্রয়োগ করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার ও কমিশন গ্রহণ;
৩। একক কর্তৃত্বে ট্রাস্ট পরিচালনার অপচেষ্টা। তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিভিন্ন উপণ্ড কমিটি চালাতে বাধ্য করে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২১-২২ অর্থ বছরে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত বিভাগীয় পর্যায়ে ঢাকা বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে গীতাপাঠ প্রতিযোগিতার আয়োজন তার একক অসহযোগিতার কারণে করা সম্ভব হয়নি। এতে ট্রাস্ট তথা সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণœ হয়েছে;
৪। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও ট্রাস্টের ফান্ড বৃদ্ধির কোনও সুব্রত পাল উদ্যোগ গ্রহণ করেননি;
৫। ট্রাস্টে কর্মরত বিভিন্ন প্রকল্পের পিডি, কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের কারণে নিয়োগ দেওয়ার পরেও কোনও কর্মকর্তা হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টে দায়িত্ব পালনে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না; উদাহরণ, মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্প, সমগ্র বাংলাদেশের সনাতন ধর্মীয় সংস্কার প্রকল্পের পিডি না থাকায় ট্রাস্টের বিভিন্ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে;
৬। মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে কর্মরত-কর্মকর্তা, কর্মচারী ও বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক দীর্ঘ আঠার মাস যাবত বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণে বিদ্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বই পাঁচ্ছে না। এ ব্যাপারে তাকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি;
৭। অবৈধভাবে দেশের টাকা বিদেশে পাঁচার করে কানাডা ও ভারতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছেন। তার সন্তানদের বিদেশে নাগরিকত্ব আছে বলে জানা গেছে;
৮। বিভিন্ন উপণ্ডকমিটির সভায় তার ইচ্ছা প্রয়োগ করতে চান। এমন একটি কারণে প্রকাশনা উপণ্ডকমিটির সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ট্রাস্টি নান্টু রায়কে প্রকাশ্য সভায় মারতে উদ্যত হন। তারপর থেকে প্রকাশনা উপণ্ডকমিটির যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ ব্যাপারে নান্টু রায় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের নিকট লিখিত অভিযোগ করেও কোনও প্রতিকার পাননি;
৯। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, সিদ্ধেশরী কালীবাড়িÑ এরকম অসংখ্য রাজনৌতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী পদে আসীন থাকায় সুব্রত পাল ট্রাস্ট অফিসে সময় দিতে পারেন না। ফলে ট্রাস্টের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। ট্রাস্টের কর্মচারীদের তার বাসস্থানে গিয়ে চেক বইয়ে স্বাক্ষর করিয়ে আনতে হয়। তার অনপুস্থিতিতে কোন মিটিং করলে তিনি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন;
১০। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, এমন কি, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের বিগত ২টি বোর্ডে অবস্থানকালে মনোনয়ন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন;
১১। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সুব্রত পাল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে শত শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় তার কয়েকটি ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে; টঙ্গীতে ১০ কোটি টাকার কারখানা, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের গ্রামের বাড়ি হিলচিয়ায় আলিশান বাড়ি রয়েছে। দেশের স্বার্থে তার এই বিপুল অর্থ সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করা প্রয়োজন;
১২। গত ২টি বোর্ডে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন, আমরা কয়েকবার বোর্ডসভায় সিদ্ধান্ত নিয়েও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারিনি, তিনি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে এ ব্যাপারে কোনও উদ্যোগই গ্রহণ করেননি, অথচ তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক;
১৩। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তাতে রাষ্ট্রের ওয়ারেন্ট অফ প্রেসিডেন্সির অবমাননা করা হয়েছে। মহান জাতীয় সংসদের একজন সম্মানীত সদস্যকে বোর্ডে ৮ নম্বরে রাখা হয়েছে। এতে একজন সংসদ সদস্যের মর্যাদা ক্ষুণœ হয়েছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা, দীর্ঘক্ষণ আমার এই বক্তব্য আপনারা শ্রবণ করেছেন, এজন্য আবারও আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকে আমি আপনাদের জানাতে চাই যে, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এই নবগঠিত বোর্ড নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়েছেন। তিনি বোর্ড করেছেন তাঁর পছন্দের লোকদের নিয়ে, অথচ বার বার বলেছেন, নাম প্রধানমন্ত্রী বাছাই করে দিয়েছেন। যাঁদের নতুন নেয়া হয়েছে, তাদের চেয়ে কী অযোগ্যতা ছিল বিগত বোর্ডের সদস্যদের, যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে? এমনকি মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, ১২১ জন ব্যক্তি ট্রাস্টি হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তবে কী ওনার দৃষ্টিতে যাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং যারা বাদ পড়েছেন, তাদের মধ্যে কী সুব্রত পালের চেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন না? এটা মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কাছে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পক্ষ থেকে আমার প্রশ্ন।