দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ছে। গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ এক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে এলসি খোলার হারও বেড়েছে। তবে ব্যাংকগুলোতে যেভাবে ডলার সরবরাহ বাড়ছে তা বাজারের চলমান ডলার সংকটের উন্নতির জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ গত বছরের এপ্রিলে দেশে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় হয়, আমদানি খরচ হয় তার চেয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার বেশি। তাতেই ডলারের সংকট শুরু হয়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম আটকে রাখায় সঙ্কটকে আরো তীব্র হয়। সরকার জ্বালানি তেল ও খাদ্য আমদানি দায় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। আর টাকার অবমূল্যায়ন করে ধীরে ধীরে ডলারের দাম বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করে। ফলে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে। তবে ডলারের সংকট পুরোপুরি না কাটলেও দিন দিন পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত নভেম্বর থেকে রপ্তানি ও রেমিটেন্স ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ৫৩৭ কোটি ডলার, চলতি জানুয়ারিতে ৫১৩ কোটি ডলার ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৬৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৩ হাজার ৭০৭ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ওই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি গত বছরের নভেম্বর মাসে কমতে থাকা প্রবাসী আয়ও বাড়তে শুরু করে। ওই মাসে ১৫৫ কোটি ডলারের রেমিটেন্স আসে। ডিসেম্বর ১৬৮ কোটি ডলার ও জানুয়ারিতে আসে ১৯৫ কোটি ডলার। তবে ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা কমে রেমিটেন্স ১৫৬ কোটি ডলার আসে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে নতুন এলসি খোলা ২৫ শতাংশ কমেছে। ফলে ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, পেট্রোলিয়ামসহ বিভিন্ন পণ্যে আমদানির প্রভাব পড়েছে। আর ওসব পণ্য আমদানি কম হওয়ায় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ৭ মাসে ৩ হাজার ৯৪৬ কোটি ডলার নতুন এলসি খোলা হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল ৫ হাজার ২৪৭ কোটি ডলার। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় গত ডিসেম্বরে ৪৭৯ কোটি ডলার ছিল। জানুয়ারিতে বেড়ে ৪৮৪ কোটি ডলারে উন্নতি হয়েছে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোতে ১ দশমিক ১১ শতাংশ ডলার ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে। বিদেশের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশী ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট ও ব্যাংকগুলোর বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা (এফসি) হিসাবে এ ডলার জমা থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি খোলার সংকট না থাকার কথা বললেও ব্যবসায়ীরা এখনো কাক্সিক্ষত এলসি খুলতে না পারার কথা বলছে। তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ডলার-সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক গত এপ্রিল থেকে নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়। তাতে রিজার্ভ কমে ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। তবে যে পরিমাণ ঘাটতি ছিল, ওই পরিমাণ ডলার বিক্রি করেনি। ফলে ব্যাংকগুলো বেশি দাম দিয়ে বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় আনতে শুরু করে। তাতে ডলারের দাম বেড়ে যায়। গত এপ্রিলে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। এখন ব্যাংকগুলোয় সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায় ডলার বিক্রি হচ্ছে। ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়া হয়। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রপ্তানিতে ডলারের দাম এখন ১০৩ টাকা এবং প্রবাসী আয় ১০৭ টাকা। বর্তমানে যেসব ব্যাংকে ডলারের বড় অংশ রয়েছে, তারা অন্য ব্যাংককে ডলার দিতে নারাজ। ফলে আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বাজার অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতির আরো উন্নতি ছাড়া আন্তঃব্যাংক লেনদেন কার্যকর করা সম্ভব হবে না। সূত্র আরো জানায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ব্যাংকগুলোর কাছে ৪৮৮ কোটি ডলার ছিল। আগস্টে ৫০১ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বর ৪৯০ কোটি ডলার, অক্টোবরে ৪৫০ কোটি ডলার এবং নভেম্বরে ৪৭০ কোটি ডলার ছিল। চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) যে পরিমাণ ডলার ধারণক্ষমতা ছিল ব্যাংকগুলোর কাছে, তা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫১ শতাংশ কম। ব্যাংকগুলোর আমদানির পেমেন্টের যে চাপ ছিল তা এখন অনেকটাই কমেছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোয় ডলার সরবরাহ পরিস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের পরিস্থিতি ভালো অবস্থানে যাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানান, রপ্তানি ও রেমিটেন্স বাড়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। যা ব্যাংকগুলোর ডলার ধারণ পরিস্থিতি দেখলেই তা বোঝা যায়। সেজন্য এখন এলসি খোলা বেড়েছে।