দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাসপ্রাপ্তির জোরালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। দেশী-বিদেশী ৩টি জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র সিলেট অঞ্চলেই প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সিলেট অঞ্চলে জোরালোভাবে জরিপ কাজ চলছে। সিলেট গ্যাসফিল্ড লিমিটেডের (এসজিএফসিএল) আওতাধীন স্থলভাগে গ্যাস ব্লক ১৩ ও ১৪-এর ৫টি এলাকায় ইতোমধ্যে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (সিএনপিসি) অধীন অনুসন্ধান ও জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ব্যুরো অব জিওফিজিক্যাল প্রসপেক্টিং (বিজিপি) থ্রিডি সিসমিক সার্ভে শুরু করেছে। ওই ব্লক ১৩ ও ১৪-এর আওতাভুক্ত মৌলভীবাজার জেলার হারারগজ, বাতচিয়া ও ডুপিটিলা এবং সিলেট দক্ষিণ ও জকিগঞ্জ এলাকায় ২ হাজার ৮১৩ বিসিএফ গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মৌলভীবাজারের হারারগঞ্জে ৪৯২ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ), একই জেলার বাতচিয়ায় ৫৭৭ বিসিএফ, ডুপিটিলায় ৬৭৯ বিসিএফ, সিলেটের জকিগঞ্জ/আটগ্রামে ৮৮৬ বিসিএফ ও সিলেট দক্ষিণে ১৭৯ বিসিএফ সম্ভাব্য গ্যাস মজুদ রয়েছে। ইতোমধ্যে চীনা অনুসন্ধানকারী দল ওই দুটি ব্লকে থ্রিডি সিসমিক সার্ভের ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। মূলত গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতেই শুরুতে টুডি এবং পরে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে করা হয়। তারপর সেসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কূপ খনন এলাকা চিহ্নিত করা হয়। আর সম্ভাবনা খুব জোরালো হলেই কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই অঞ্চল ও সংলগ্ন এলাকায় বেশকিছু গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার অবস্থানও ১৩ ও ১৪ নম্বর ব্লকের কাছে। ফলে ভূতাত্ত্বিকরা সেখানেও গ্যাস পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন। সূত্র জানায়, দেশের স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। সিলেট অঞ্চলে গ্যাস মজুদের সমীক্ষা নিয়েও থ্রিডি সিসমিক প্রকল্পের কাজ চলছে। থ্রিডি সিসমিকের পর গ্যাস কূপ খননের জায়গাগুলো চিহ্নিত করান পর সেখানে কূপ খনন করে চাপ ও মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে যে পাঁচটি এলাকায় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে আগেও গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সিলেটের জকিগঞ্জে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের ২৮তম গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স সেখানে ওই গ্যাসক্ষেত্রে ৬৮ বিসিএফ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করে। তাছাড়া ব্লক ১৩ ও ১৪ভুক্ত এলাকাগুলোর পাশেই রয়েছে রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, জালালাবাদ ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্র ছাতক। ইতোমধ্যে ছাতকে বিপুল পরিমাণ গ্যাস থাকলেও কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে মামলা জটিলতার কারণে আজও তা উত্তোলন সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ব্লক ১৩ নম্বরের বাতচিয়া কমলগঞ্জ উপজেলার ৫ ইউনিয়ন ও কুলাউড়া উপজেলার ২টি ইউনিয়ন মিলিয়ে ১২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সার্ভে, ড্রিলিং ও তেল-গ্যাস মজুদ বিষয়ে রেকর্ডিং কাজ শেষ করা হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় তিনটি ধাপে কাজ শেষ হয়েছে ব্লক ১৪ নম্বরের হারারগজের আওতাভুক্ত কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৩৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়ও। সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১০ সালে দেশে গ্যাসের মজুদ নিয়ে মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা চালায়। তাদের পর্যবেক্ষণে দেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। আর দেশে এমন অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফেরও বেশি। ৫০ শতাংশ সম্ভাবনার গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় সম্ভাব্য মজুদ প্রায় ৬৩ দশমিক ১৯ টিসিএফ। ওই সমীক্ষার পর এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ নিয়ে নরওয়ের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেটের (এনপিডি) সমীক্ষায় জানানো হয়, বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ রয়েছে ৪২ টিসিএফ। সম্প্রতি বাংলাদেশে ইউরোপীয় জ্বালানি তেল-গ্যাসবিষয়ক পরামর্শক সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ টিসিএফ অনাবিষ্কৃত গ্যাস রয়েছে। এদিকে ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনে দেশে আরো অনেক বেশি গ্যাসের মজুদ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। বিশেষ করে যেখানে বড় বড় গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে তার আশপাশে আরো অনেক মজুদ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। পৃথিবীর সব ডেল্টা এরিয়ায় গ্যাস আছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হবে না। বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুযায়ী এখানে গ্যাসের সম্ভাবনা খুবই ভালো। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের যে পরিমাণে অনুসন্ধান করা দরকার, সেটা কখনোই করা হয়নি।