সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে খুলনার পাইকগাছায় ৬ ইটভাটা ও প্রায় একশ চুল্লিতে পুড়ছে হাজার হাজার মন কাঠ। স্রােতের বেগে উজাড় হচ্ছে এলাকার সামাজিকসহ প্রাকৃতিক বন। অধিকাংশ ইটভাটা ও চুল্লি সরকারি জায়গা দখল করে পরিচালিত হচ্ছে। একের পর এক ণির্মাণ হচ্ছে অবৈধ চুল্লি। আর ভূমিদস্যুরা বছরের পর বছর ইটভাটায় সরকারি জমির মাটি বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর সরকারি সম্পদণ্ডসম্পত্তি নষ্ট বা গ্রাস করলেও সংশ্লিষ্টরা নিরব। গত ১ জানুয়ারি পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকায় ৬টি ইটভাটায় ৭ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেন পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আসিফুর রহমান। ইটভাটা ও চুল্লিগুলো ফসলী জমি, বসতবাড়ি ও বিদ্যালয় মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঅঙ্গুলি দেখিয়ে চাঁদখালীতে ৭টি ইটভাটার মধ্যে স্টার ব্রিক্স মালিক আবদুল হালিম খোকন, এমবিএস ব্রিক্স মালিক হাজী শফি গাজী, আল্লাহর দান ব্রিক্স মালিক আবদুল জলিল সরদার, বিবিএম ব্রিক্স মালিক আবদুল মান্নান, এডিপি ব্রিক্স মালিক মো. মহিউদ্দিন খান ও একই উপজেলার রাড়-লী এসএমবি ব্রিক্স মালিক মিঠুন সরদার ইটভাটায় নির্বাধায় হাজার হাজার মন কাঠ পুড়াছেন। ইট তৈরীর কাঁচামাল মাটি আসছে সরকারি জমি থেকে। ভেকু দিয়ে দিনরাতে আবাদি ভূমির উপরি অংশ টপণ্ডসয়েল কেটে আনা হচ্ছে। ট্রাকে মাটি আনতে নষ্ঠ হচ্ছে সরকারি পিচের রাস্তা। রাস্তা মাটি পরে বর্ষা মৌসুমে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা সাধারন মানুষের। সামাজিক ও প্রাকৃতিক বন উজাড়ে আরএক মাধ্যম কাঠ কয়লার চুল্লি। এ চাঁদখালী ইউনিয়নে প্রায় একশ চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে বানানো হচ্ছে কয়লা। পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গত বছর সেপ্টম্বর মাসে ৫টি কয়লার চুল্লি ধ্বংস করেন। বাকি চুল্লিগুলো বন্ধ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মানবিক কারণে ১ মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কার্যক্রম বন্ধ ও অপসারণ করার শর্তে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাদা আবু ইলিয়াস মুচলিকা দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেন। এক মাসের পরিবর্তে ৬ মাস অতিবাহিত হলেও চুল্লি বন্ধ না করে, উল্টো পুরোদমে চলছে। এমনকি নতুন করে আরো চুল্লি তৈরী করা হচ্ছে। প্রশাসনের নিরবতায় একের পর এক অবৈধ কয়লার চুল্লি নির্মাণ অব্যাহত। উপজেলার চাঁদখালী ইউনিয়নের চককাওয়ালী গ্রামের দুই প্রভাবশালি রেজাউল গাজি ও সিরাজুল গাজির খাস জায়গা ভরাট করে চুল্লি নির্মাণ করছে। সরেজমিন ও স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানাযায়, উপজেলার চাঁদখালী বাজার হতে ১কিলোমিটার দক্ষিণে বদর দরগাঁ মসজিদ সংলগ্ন চককাওয়ালী মৌজার এসএ ৩৩১ ও বিআরএস ২৪১ দাগের ১নং খাস খতিয়ানের কপোতাক্ষ নদের চরভরাটি ২ একরের ও বেশি জায়গা দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে দখলে রেখেছেন এ দুই প্রভাবশালি। তবে সম্প্রতি সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ঐ জায়গার অর্ধেক অংশে তারা মাটি কেটে বড় বড় পুকুর খনন করেছেন এবং খননকৃত ঐ মাটি তারা জমির বাকী অংশ ভরাট করে অবৈধভাবে কয়লার চুল্লি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, তারা এতটাই প্রভাবশালি যে ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তারা তাদের কে ভয়-ভীতি সহ মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে দেয়। এজন্য তাদের অপকর্ম সকলে মুখ বুজে সহ্য করছে। মো. লাভু গাজী ৯টি, হালিম রেজা মিঠু ৭টি, আবদুল হালিম খোকন ৭টি, জিয়াউর রহমান কমল ৫টি, জয়নাল হোসেন ৫টি, সেলিম রেজা লিটু ৩টি, হাইদার সরদার ৩টি, আজিজুর রহমান ৪টি ও শাহীন হোসেন ৩টি। এ ৯জন ৪৬টি ও বাকি প্রায় ৫০টি চুল্লি ৩০জন পরিচালনা করছে। বিশ্বের-সব চেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন সংলগ্ন ইটভাটা ও চুল্লিতে পুড়ছে কাঠ। একটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মন পর্যন্ত কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতিবার কমপক্ষে ২৫ হাজার মন কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতিমাসে প্রত্যেকটি চুল্লিতে ৩ থেকে চারবার কাঠ পুড়িয়ে কয়লা করা হয়। ফলে প্রতিমাসে কয়লার চুল্লিতে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মন কাঠ পোড়ানো হয়। ফলে ইটভাটা ও কয়লা চুল্লিতে রাতদিন পোড়ানো হচ্ছে অবাধে কাঠ। এতে ধ্বংস হচ্ছে আশেপাশের প্রাণ-প্রকৃতি। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ। ইটভাটাগুলোর একটিতেও নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এরপরেও বছরের পর বছর চলছে ইটভাটা ও কয়লা চুল্লি। এ ব্যাপারে দু'প্রভাবশালি রেজাউল গাজি ও সিরাজুল গাজি জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ডিসিআর মূলে ভোগ দখলে আছি। ঐ জায়গায় মাটি কেটে ভরাট করে চুল্লি ও খামার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ইট পুড়াতে কাঠের ব্যবহার সহ সরকারি জায়গার উপর এমবিএস ব্রিক্স মালিক হাজী শফি গাজীর মুঠোফোনে মন্তব্য নিতে গেলে রিসিভ করে একাধিকবার একটু পরে বলে লাইন কেটে দেন। ৫টি চুল্লি মালিক জিয়াউর রহমান কমল বলেন, চুল্লি ব্যবসা আমাদের নেশা ও পেশা। ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজাদা আবু ইলিয়াস বলেন, আমি চুল্লি বন্ধ করতে না পারায় ইউএনও স্যারকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। লস্কর ইউনিয়নের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মীর রেজওয়ান বলেন, সরকারি কোনো নিয়মনীতির বাইরে কোনো কাজ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। বিষয়টি তদন্তপূর্বক উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মমতাজ বেগম বলেন, উপরের স্যারদের জানিয়েছি। তবে ইটভাটায় সরকারি সম্পত্তি থাকার কথা জানান তিনি। পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (উপসচিব) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ইটভাটা ও চুল্লিতে আগেও দু’বার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। আবারো ব্যবস্তা নেওয়া হবে।