নানাবিধ কারণে বিলুপ্তির পথে খুলনা পাইকগাছায় কপিলমুনি ৪শ’ বছরের ঐতিত্যবাহি বারুণীমেলা। বিগত কয়েক বছরে মতো এবারও কপিলমুনি কপোতাক্ষ নদের ঘাটে ঐতিহ্যবাহী মহাবারুণীর স্নানোৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। স্নানোৎসব রোববার রাত ৯টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কপিলমুনি কপিলেশ্বরী কালী মন্দির স্নান ঘাটে পালন করে আসছেন বারুণীর স্নানোৎসব। তবে কয়েক বছর বৈশ্বিক মহামারী করোনাসহ নানা সংকটে এবারো কোনো প্রকার মেলার আয়োজন ছাড়াই শুধুমাত্র স্নানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো বারুণী স্নানোৎসব। কপিলমুনি বারুণী স্নান ইতিহাস থেকে জানাযায়, প্রায় ৪শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে কপিল দেব নামে এক মুনি কপোতাক্ষের সুন্দরবন উপকূলীয় কপিলমুনি কালী মন্দির সংলগ্ন কপোতাক্ষ নদের তীরে তপধ্যানে মত্ত থেকে সিদ্ধিলাভ করেন। তার সিদ্ধিলাভের দিনেই সেই স্মরণাতীত কাল থেকে জনপদের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কালীবাড়ী ঘাটে বারূণী স্নান করে আসছেন। কথিত আছে, কপিল দেবের এক ভাই জরাসন্ধ ১শ’ নৃপতিকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে নরমেধ যজ্ঞ শুরু করেন। এ লক্ষ্যে তিনি হত্যাকান্ড শুরু করলে তার বৈমাত্রেয় ভাই কপিলতাকে প্রশমনে ইশ্বরের সাহায্য প্রার্থনায় সিদ্ধিলাভের আশায় বিভিন্ন স্থানে তপধ্যান শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি কপিলমুনি কপিলেশ্বরী কালীবাড়ী স্নান ঘাট সংলগ্ন বটবৃক্ষের মূলে বসে তপধ্যান শুরু করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। ঐসময় তিনি যে সকল স্থানে তপধ্যান করেছিলেন, সেই সকল স্থানে প্রতি বছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বারুণী স্নানোৎসব পালন করে আসছেন। তাদের বিশ্বাস মতে, এই তিথিতে গঙ্গার জল এই স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়। এবং গঙ্গার জলে স্নান করলে সারা বছরের পাপ মোচন হয়। আর সেই লক্ষ্যে জনপদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা স্মরণাতীত কাল থেকে স্নানোৎসব পালন করেন। তবে অনেকে মনে করেন, বরুণ জলের দেবতা, আর বারুণী তার স্ত্রী। তাকে তুষ্ট করতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বারুণী স্নান করে থাকেন। তবে মতান্তর থাকলেও স্মরণাতীতকাল থেকে কপিলমুনি কপিলেশ্বরী স্নান ঘাটে পালিত হয়ে আসছে বারুণী স্নানোৎসব। এ ছাড়া স্নানোৎসবকে ঘিরে কপিলমুনিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বারুণীমেলা। মেলা উপলক্ষে একসময় যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ, নাগর দোলা, মৃত্যুকূপ, জাদু প্রদর্শনীরসহ চিত্ত বিনোদনের নানা পসরার সাথে বসত বিভিন্ন খেলনা, কাঠের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় নানা পসরায় সাজানো হতো মেলা। আসতো দূর-দুরন্ত থেকে মানুষ। তবে কয়েক বছর আগে থেকে স্থানীয়দের সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিক অস্থীরতা, জায়গার অভাবসহ নানা সংকটে দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ বন্ধ রয়েছে বারুণী মেলা। বারুণীমেলা চলত এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে পক্ষ কাল কিংবা ১ মাস পর্যন্ত। বারুণী স্নান সনাতনীরা করলেও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিলে-মিশে মেলা উদযাপন করতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদের সকল ধর্ম বর্ণের মানুষরা। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে মেলা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে ঐতিহ্যবাহী বারুণীমেলা। গত কয়েক বছর এদিন বারুণীমেলা উপলক্ষে সনাতনীরা মহানাম যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। কালের বিবর্তনে বারুণীমেলা এখন শুধুই ইতিহাস। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, কপিলমুনি বারুণীমেলা স্নানোৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়েছে। দশ বছর আগেও কত দূর-দুরন্ত থেকে লোকসমাগম হতো, চিত্তবিনোদসহ নানা পসরা নিয়ে বাহারী দোকান বসতো। আগামীতে ৪শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটিকে আগের ন্যায় ফিরিয়ে আনতে সনাতন ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।